'টাকার পাহারাদার' নুরু মিয়া পেলেন আমেরিকাপ্রবাসীর অর্থ সহায়তা

আমেরিকা প্রবাসীর সহায়তা তুলে দেওয়া হচ্ছে নুরু মিয়ার হাতে
ছবি: লেখক

‘নুরু মিয়া একজন টাকার পাহারাদার’ শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলোর নাগরিক সংবাদে আমার একটা লেখা প্রকাশিত হয় ১২ এপ্রিল। নুরু মিয়া কাজ করেন দুই শিফটে একটা প্রাইভেট ব্যাংকের বুথে নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে। নুরু মিয়ার সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হতো বুথে গেলে। হঠাৎ একদিন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছা হলো। কিন্তু কথা বলার মতো শক্তি ও মনোবল তাঁর শরীরে নেই। দেখলেই বড্ড মায়া হয়। একদিন গল্পে গল্পে জানা হলো তাঁর হতদরিদ্র জীবনের কথা। সম্প্রতি স্ট্রোক করে হাসপাতালে পড়ে আছেন উনার পরিবার (স্ত্রী)। ছেলেমেয়ে থাকলেও বৃদ্ধ মা–বাবাকে দেখভাল করার মতো আর্থিক অবস্থা ও মানসিক ইচ্ছা কোনোটাই তাঁদের নেই।
কাকডাকা ভোরে পায়ে হেঁটে কামরাঙ্গীরচর থেকে রোজ কাজে আসেন নুরু মিয়া। ঘরে ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে যায়। দুপুরে এখানে–ওখানে খেয়ে নেন যখন যা পান। রাতে ঘরে ফিরে নিজেকেই কয়েকটা চাল ফুটিয়ে নিতে হয়। নিতান্তই দুঃখ ভারাক্রান্ত এক জীবন নুরু মিয়ার।

যা–ই হোক, প্রকৃতি যতই বিরাগভাজন হোক না কেন আমাদের ওপর, আজও পৃথিবীজুড়ে রয়েছে মহৎ মানুষের বিচরণ। আমার এ লেখা তেমনই এক সুন্দর সত্যের উপমা খুঁজে পেয়েছে নুরু মিয়ার জন্য। আমার ছোট্ট গল্পটা চোখ এড়াতে পারেনি সানি দত্ত নামের সুদূর আমেরিকাপ্রবাসী এক বাঙালির। যিনি প্রথম আলোর একজন নিয়মিত পাঠক। গল্পটি পড়তে পড়তে সানির চোখ আটকে যায় নুরু মিয়ার বিবর্ণ চেহারা আর অবর্ণনীয় জীবনের মায়াজালে। ব্যথিত হন তিনি। মনে মনে ভাবেন, কী করে পাশে দাঁড়ানো যায় এমন একজন বাবার বয়সী অসহায় নুরু মিয়ার পাশে।
সানি দত্ত প্রযুক্তির মাধ্যমে খুঁজে বের করেন গল্পের লেখককে। সবিনয়ে জানতে চান নুরু মিয়া সম্পর্কে বাকি গল্পটুকু। কিন্তু একজন লেখক হিসেবে লেখাটাই যার কাজ, তিনি কী করে সাহায্য করবেন, ঠিক তা বুঝে উঠতে পারেন না। তাই লেখক তাঁর অফিস সহকারী রাকিব খানকে দিয়ে নুরু মিয়ার পাশে দাঁড়ানোর সব ব্যবস্থা করে দেন।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে জন্ম হলেও এখানকার আলো–বাতাস আর নদীর শীতলতা টের পাননি আমেরিকার মতো বিশাল পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা সানি দত্ত। তাই শুরুর দিকে বেশ বাগ্‌বিতণ্ডা হয় লেখকের সঙ্গে তাঁর বিশ্বাস–অবিশ্বাস নিয়ে। বাংলাদেশ দুর্নীতিতে যথেষ্ট বদনাম কুঁড়িয়েছে যেখানে, সেখানে একজন অচেনা আমাকে বিশ্বাস করেনই–বা কী করে। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম, কাউকে সাহায্য করতে লাগে বিশ্বাস আর একটা বৃহদাকার হৃৎপিণ্ড। কাজেই আমাকে বিরক্ত না করে পত্রিকা অফিসে যোগাযোগ করুন।

অচেনা একজন মানুষের ওপর অভিমান করে নুরু মিয়াকে বঞ্চিত করার কোনো অধিকার আমার নেই। তাই সরি বলে নুরু মিয়ার ম্যানেজারের নম্বরটা পাঠিয়ে দিলাম ভদ্রলোককে।

লকডাউনের কারণে সানি দত্ত সময়মতো টাকাটা পাঠাতে না পারলেও ভুলে যাননি নুরু মিয়ার কথা। গত ২৪ মে সানি দত্ত তাঁর বন্ধু জুয়েলের মাধ্যমে নুরু মিয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পাঠান ডাচ্‌–বাংলা বুথের এডিসি ম্যানেজার আবদুস সালামের ব্যাংক একাউন্টে। জুয়েল আমাকে ফোন করে বলেন, আপু টাকাটা নুরু মিয়া পেলেন কি না জানাবেন। আর আপনার কাছে এমন আরও হাজারো নুরু মিয়াদের গল্প শুনতে চাই।

চোখের কোণ ভিজে গেল জুয়েলের কথায়। এক আশা জাগানিয়া দায়িত্ব অনুভব করলাম নিজের গহীন ভেতরে। আসলে ভালো থাকা কেবল নিজের জন্য নয়। সত্যিকার বেঁচে থাকার সার্থকতা অন্যের জন্য। যদিও সানি দত্ত চাননি তার নামটা এভাবে কাগজে আসুক। এই প্রথম উনি এভাবে কাউকে সাহায্য করলেন বলে জানিয়েছেন।

ভালো থাক নুরু মিয়ারা। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাক এমন হৃদয়বান সানিরা। মানুষ হয়ে উঠুক মানবিক।

*রোজিনা রাখী: সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ