সামাজিক বিনোদনমূলক অ্যাপস ও আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়

একবিংশ শতাব্দীতে গ্লোবাল ভিলেজ সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের যেভাবে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে তা অভাবনীয়, যেখানে আমরা প্রতিমুহূর্তে যোগাযোগ করতে পারি, ভিডিও কলে কথা বলতে পারি, ভার্চ্যুয়াল মিটিং করতে পারি। এমনিভাবে লা-লিগা, প্রিমিয়ার লিগের খেলাগুলো এশিয়া থেকে লাইভ সম্প্রচারে দেখতে পারি। সমসাময়িক উদাহরণ যদি না দেওয়া হয় তাহলে বোঝা যাবে না যে সামজিক মিডিয়ার আশীর্বাদ কতটা গুরুত্বপূর্ণ মানবজীবনের জন্য। করোনাভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবী স্থবির হয়ে যায় দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনে, সেখান থেকে অর্থনৈতিক চাকা ঠিক রাখার জন্য অনলাইনভিত্তিক অফিস, মিটিং, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো হয়েছে।

আমাদের শিক্ষা বিভাগের কথায় যদি আসি, আমাদের বেশির ভাগ ইউনিভার্সিটির ক্লাসগুলো অনলাইনে হয়েছে বা হচ্ছে। যা–ই হোক, এতক্ষণ যে এত এত উদাহরণ দিলাম কারণ হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশ্ববাসীর জন্য যে কতটা আর্শীবাদ, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না, তবে এর মাঝে কিছু তিক্ত কথা আছে, যা আমাদের সুন্দর, সুগঠিত, সুশীল সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে কিছু সামাজিক যোগাযোগভিত্তিক বিনোদনমূলক অ্যাপস। সবারই এতক্ষণে জানা হয়ে গেছে আমি কী নিয়ে কথা বলতে চাই। দেখেন, আমাদের সমাজে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়েছে, নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। এতে নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানির মতো ভয়াবহ নিষ্ঠুর কাজগুলো হচ্ছে। ধরেন, আপনি শখের বসে লাইকি বা টিকটক অ্যাপস ডাউনলোড করলেন। চিন্তা করলেন আমি শুধু ভিডিওগুলো দেখব। এভাবে দেখতে দেখতে দেখলেন যে আপনার ভেতর একটি প্রভাব বিস্তার করবে। কারণ লাইকি বা টিকটক ভিডিও যাঁরা তৈরি করেন, সিংহভাগ অশ্লীল ভিডিও, যেখানে কিশোরী মেয়েরা নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন, যাতে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ে, লাইক, কমেন্ট বাড়ে। এসব দেখে আপনিও নিজের মধ্যে ভাবতে থাকেন আমি যদি এই পোশাকটা পরতে পারতাম, তারা মনে হয় অনেক স্মার্ট! আমি যদি এই পোশাক পরে কোথাও ঘুরতে পারতাম! হয়তো আপনার মনেও ইচ্ছা জাগতে পারে আমিও টিকটক করব। তারপর আপনিও তাদের মতো করে অঙ্গভঙ্গি করে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাইবেন।

এবার আসি কিশোরদের কথায়, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে কিছুদিন আগে অপু আর মামুন নামের ছেলেরা কীভাবে সমাজকে অস্থীতিশীল করে তুলেছিল। এমনকি মারামারি পর্যন্ত হয়েছে এই লাইকি এবং টিকটিক ফ্যান ফলোয়ার নিয়ে। তাদের ফ্যান ফলোয়ার অনেক থাকতে পারে কিন্তু তাদের ভিডিওগুলো ছিল অশ্লীলতায় ভরা, যেখানে অকথ্য ভাষায় কথাগুলো ফুটিয়ে তোলা হতো। এখন এই অ্যাপসগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিও হাতের মুঠোতে আমার ছোট ভাইবোন, আপনার সন্তান দেখতে পারে। আর ১৪–১৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা আবেগপ্রবণ থাকে, তারা যা দেখে তাই চিন্তা করে, আমি যদি এমন হতে পারতাম! আমার যদি এত জনপ্রিয়তা হতো! তখন এ ভিডিওর প্রভাবে তারাও পা বাড়িয়ে দেয় ভিন্ন জগতে এবং ওই তথাকথিত সেলিব্রেটিদের অনুকরণ করে পোশাক বা তাদের মতো চুলের কাট, বখাটেপানা করে বেড়ায়, যা সামাজিক নৈতিকার অবক্ষয়।

কথাগুলো যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে আজই এসব অ্যাপসে ভিডিও দেখে নিজেকে প্রশ্ন করবেন যে আসলে ভিডিওগুলো কতটুকু দেখার উপযোগী আমার সন্তানের জন্য। আগে যেখানে কিশোর-কিশোরীরা সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে ভাবত, বাড়ির কাজে মা–বাবাকে সাহায্য করত, আজ কিনা সে সারা দিন লাইকি, টিকটক ভিডিওতে ব্যস্ত, মা–বাবার অবাধ্য হচ্ছে, ছেলেমেয়ে পড়াশোনা থেকে অনীহা প্রকাশ করছে। কারণ সে আটকে আছে সেই রঙিন দুনিয়াতে। এই ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি আজ গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছে।

আগে দেখা যেত গ্রামের ছেলেরা বিকেল হলে মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল খেলত বা মেয়েরা তাদের অঞ্চলভিত্তিক খেলাগুলো উপভোগ করত এবং খেলত, যেখানে তাদের মানসিক বিকাশ হতো, সামাজিক বন্ধন হতো। কিন্তু এখন তারা পড়ে আছে এক রঙিন দুনিয়াতে, এতে সামজিক মূল্যবোধ, দায়িত্বশীলতা, নৈতিকতার মতো গুণগুলোর অবক্ষয় হবে। এতে কিশোর অপরাধ, কিশোর গ্যাংয়ের মতো সংগঠন গড়ে উঠবে, যেখানে সমাজের মানুষের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন, নির্যাতনের মতো কাজগুলো হয়ে থাকবে। আজ আমাদের সচেতন হতে হবে আমার ভাইবোন কী করছে, সন্তানেরা কী করছে, কী ধরনের কাজগুলো করছে, সে মোবাইল দিয়ে কী করছে, তা নিয়ে। এটা আমার আর আপনারই দায়িত্ব।

চলুন সমাজটাকে বাঁচাই, সমাজ বাঁচলে দেশ বাঁচবে। যেখানে মানুষ সুন্দর, সাবলীলভাবে, সুখে–শান্তিতে বসবাস করতে পারে। এতে আমরা আগামীতে সুন্দর একটি সুশিক্ষিত, সভ্য জাতি নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।

  • শিক্ষার্থী, ফার্মেসি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি