সমুদ্রনামা

সমুদ্রে গাঙচিল
ছবি: লেখক

ভ্রমণের জন্য আমার আগ্রহের তালিকায় ওপরেই থাকে পাহাড় আর সমুদ্র। কারণ, তাদের বিশালতার কাছে নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হয়। আর এই ‘ক্ষুদ্র’ মনে হওয়াটাই নিজের মনের কোণে জমে থাকা আত্মগরিমাকে এক ঝটকায় উড়িয়ে দেয়। ভ্রমণ অনেকের কাছে সেলফি আর স্লো মোশন ভিডিওগ্রাফির উপলক্ষ হলেও আমার কাছে ভ্রমণ মানেই আত্মশুদ্ধির এক অনন্য প্রেসক্রিপশন। সেই প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করেই গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে যাওয়া হয় সেন্ট মার্টিনে। ঢাকা থেকে টেকনাফ, সেখান থেকে জাহাজে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা। শুরুতেই ঝাঁক বেঁধে অসংখ্য গাঙচিলের অভিবাদন। প্রতিটি জাহাজকে ওরা এমনিভাবে পিছু নিতে থাকে পর্যটকদের দেওয়া খাবারের আশায়। চিপস, বিস্কুট, যে যা দিচ্ছে, মুখে পুরে নিচ্ছে পরম বিশ্বস্ততায়। পৃথিবীর সবচেয়ে অবিশ্বাসী প্রাণী ‘মানুষ’কে এভাবে বিশ্বাস করার পেছনে প্রাণিবিজ্ঞানীরা তাঁদের বুদ্ধিমত্তার অভাবকে দায়ী করতে পারেন, কিন্তু আমার কাছে ওদের এই আচরণ সরলতা এক বিমূর্ত প্রতিমাস্বরূপ।

ওয়েবসাইট বা বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে মনে হয়েছিল, টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন যেতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লাগবে। কিন্তু মাত্র তিন ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম সেন্ট মার্টিনে। জাহাজ ঘাটে ভিড়তেই বাঙালিদের চিরায়ত হুড়োহুড়ি, কে আগে নামবে, তার এক অযাচিত প্রতিযোগিতা। সেই সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে জেগে ওঠে কর্মচাঞ্চল্য। কেউ পর্যটকদের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতে ব্যস্ত, কেউ আবার হোটেল বুকিংয়ের আকর্ষণীয় মূল্যহ্রাসের তথ্য দিতে ব্যস্ত। প্রথমবার সস্ত্রীক ভ্রমণ করায় আগে থেকে সবকিছু ঠিক করা ছিল। রুমে চেকইন করেই এক মিনিট দূরত্বে থাকা সমুদ্র দিকে ছুটে যাওয়া।

সমুদ্র শুধু বিশাল জলরাশি নয়, তার মধ্যে সম্মোহন করার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। প্রকৃতির নিয়ম মেনে প্রতিটি ঢেউ যেন নিজের স্বকীয়তায় অনন্য। কিছু ঢেউ পরম মমতায় সমুদ্রতটে দিয়ে যাচ্ছে ঝিনুক আবার কিছু ঢেউ প্লাস্টিক বর্জ্য ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের হীন মানসিকতার জানান দিচ্ছে। নীল জলরাশির নুড়িপাথরে আছড়ে পড়ে যখন নিজেকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়, সেই আর্দ্রতা হৃদয়কে শীতল করে দেয় নিমেষেই। বিশাল সমুদ্র মাঝেমধ্যে আলতো করে যখন পা ভিজিয়ে দিয়ে যায়, তখন শুধু মনে হয়, সমুদ্র বিশাল হয়েও কত নিরহংকারী!

এ ভাবনায় ছেদ পড়ল স্ত্রীর ছবি তুলে দেওয়ার আবদারে। নিজেদের ছবি তোলার ব্যাপারে কিছুটা অনীহা থাকলেও প্রকৃতির ছবি তুলতে আমি ভীষণ লোভী। যদি আর এই জীবনে আসা না হয়—এই ভাবনা সব সময় কাজ করে। তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসের শেষ লাইনটা আমার ভীষণ পছন্দের, ‘জীবন এত ছোট কেনে?’

ছেঁড়া দ্বীপ
ছবি: লেখক

মাত্র আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের সেন্ট মার্টিন গাণিতিকভাবে ছোট মনে হলেও এর বৈচিত্র্যের কারণে একে বিশাল মনে হবে। স্থানীয়ভাবে পেজালা নামে পরিচিত Sea weeds বা অ্যালগি একধরনের সামুদ্রিক শৈবাল সেন্ট মার্টিনে প্রচুর পাওয়া যায়। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে স্পঞ্জ, শিলকাঁকড়া, সন্ন্যাসী শিলকাঁকড়া, লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরি মাছ, প্রজাপতি মাছ, বোল করাল, রাঙা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ, উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি।

শীতকালে দিনের আলো খুব কৃপণ থাকে, শেষ বিকেলে হঠাৎই সন্ধ্যা নামিয়ে দেয়। আর নীল আকাশ, নীল জলরাশির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার, সঙ্গে রক্তিম সূর্য—যেন এক পরাবাস্তব সৌন্দর্যের মঞ্চায়ন। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাজার তারার মেলা। আকাশের তারা গোনা নাকি একই সঙ্গে অসম্ভব আর বোকা একটি কাজ। আশ্বস্ত করছি, সেন্ট মার্টিনের এই পরিবেশে বাকি জীবনটা এই তারা গোনায় চলে যেত, তাহলে যাপিত এই জীবন নিয়ে একটুও আফসোস থাকত না। প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রতিটি মুহূর্তই আমার কাছে জীবন, আর বাকিটা সময় শুধু মৃত্যুর আয়োজন।

দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁটার পর নিজের মনের ও নিজের মাংসপেশির একটুও অভিযোগ নেই। ৫ থেকে ১০ মিনিট হাঁটার দূরত্বে রিকশার বায়না করা আমার স্ত্রীও হেঁটেছে ক্লান্তিহীনভাবে। পেটুক না হলেও নতুন জায়গায় প্রতিটি খাবারের স্বাদ দেওয়ার একটা লোভ আমার সব সময় কাজ করে। কারণ একটাই, যদি আর আসা না হয়! ভাবনাটাও খুব বেশি অযৌক্তিক নয়। আমাদের সবার জীবনেই এমন জায়গা আছে, যেখানে আমাদের প্রথম ও শেষবার যাওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় বাজারে পর্যটকদের অভিজাত শ্রেণিতে গণ্য করা হয়। ৫ টাকার চা ২০ টাকায় খেতে একটু বিরক্ত লেগেছিল, তবে সবচেয়ে মুখরোচক ছিল ‘মাছভাজা’। রুপচাঁদা, ফ্লাইং ফিশের স্বাদ অসাধারণ লেগেছে। কোরাল মাছের বারবিকিউ আমার খাওয়া সবচেয়ে তৃপ্তিকর খাবারের তালিকার মধ্যে ওপরের দিকেই থাকবে। মৎস্যরসিক না হলেও আমার মনে হয় প্রতিটি সামুদ্রিক মাছের স্বাদ বিভিন্ন, কিন্তু সুস্বাদু।

মাছ ভোজনের পর্ব শেষ করে আরও কিছুক্ষণ বাজার ঘুরে দেখা হলো। উদ্দেশ্য কিছু শুঁটকি কেনা। মূল্য ঢাকায় চেয়ে অনেক সস্তা হলেও পর্যটক কোটায় যাওয়া আমাদের কাছে দাম কিছু বেশি রেখেছে, তা বলাই বাহুল্য। রাত বাড়ছিল, এতক্ষণ অভিযোগহীন মাংসপেশিগুলো জানান দিচ্ছিল আজ আর নয়। আগামীকাল ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়ার পরিকল্পনা থাকায় পায়ের সঙ্গে সঙ্গে মনও বলল এখন বিশ্রামের পালা। হাজার ভাবনা আর জীবন নিয়ে কতশত উপলব্ধি নিয়ে রাতে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

সৈকতে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্ত্রীকে তৈরি হওয়ার জন্য তাড়া দেওয়া আমার সব সময়ের অভ্যাস। আর আমার তাড়ায় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আরও দেরি করে ফেলা আমার স্ত্রীর অভ্যাস। ‘তাড়াহুড়োয় দেরি করে ফেলা’ আমাদের ঠিক সকাল আটটায় শুরু হলো ছেঁড়া দ্বীপের উদ্দেশ্য যাত্রা। ছেঁড়া দ্বীপে যেতে চাইলে সাইকেল/বাইক, স্পিডবোট আর ট্রলার—তিনটি মাধ্যম আছে। শীতকালে সাগর শান্ত থাকায় তিনটি মাধ্যমই নিরাপদ। আমাদের যাওয়া হলো ট্রলারে। ট্রলারে প্রতিটি যাত্রীর জন্য লাইফ জ্যাকেটের বাধ্যবাধকতা থেকেও তা কোনো প্রয়োগ দেখতে গেল না। ট্রলারে করে প্রায় দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম ছেঁড়া দ্বীপ। ছেঁড়া দ্বীপের পানি আরও বেশি নীল, মনে হবে পৃথিবীর সব নীল রং ধার করে নিজেকে সাজিয়েছে ছেঁড়া দ্বীপ। পানি এতই স্বচ্ছ যে পাঁচ থেকে ছয় ফুট নিচের শৈবাল, মাছ পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল। মনে হবে বড় কোনো অ্যাকুয়ারিয়ামের মধ্যে আমার ট্রলার নোঙর করে আছে।

দ্বীপে নেমেই পরিবেশ অধিদপ্তরের সাইনবোর্ডে কিছু নীতিমালা চোখে পড়বে। দ্বীপের একটু ভেতরে যেতেই চোখে পড়বে প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, তারা মাছ, কাছিম, রাজকাঁকড়া, সামুদ্রিক ঘাস, সামুদ্রিক শৈবাল এবং কেয়া ফল।

ছেঁড়া দ্বীপ যদি কোনো রাজত্ব হয়, তাহলে সেই রাজত্বের রাজা লাল কাঁকড়া, ঝিনুক আর শামুক। ছয় পা নিয়ে রাজকীয় চালে হেঁটে চলছে লাল কাঁকড়া, নরম মাটিতে এঁকে দিচ্ছে পদচিহ্ন। বাহারি রঙের ঝিনুক আর শামুক দেখে এই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্লোভ মানুষটিরও পকেটে পুরে নেওয়ার লোভ হবে। তবে শীতকাল হলেও দিনের এই সময় সূর্যের বেশ দাপট। তাই তৃষ্ণা নিবারণে আছে ডাব, সুমিষ্ট পানি; কিন্তু পর্যটক কোটায় প্রতিটির মূল্য ৬০ থেকে ৭০ টাকা!

সাগরের ঢেউয়ের শব্দ এত মোহাবিষ্ট করতে পারে, ছেঁড়া দ্বীপে না এলে জানা হতো না। মনে হবে, কারও এক অদৃশ্য নির্দেশে সাগরের ঢেউ বিরামহীনভাবে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রতটে। এই অনুভূতিগুলো সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিজের বিশ্বাসকে আরও প্রগাঢ় করে। শুরুতেই আত্মশুদ্ধির যে প্রেসক্রিপশনের কথা বলেছিলাম, সেই প্রেসক্রিপশনের পূর্ণতা পাওয়া গেল ছেঁড়া দ্বীপে এসে।

সময়ের সীমাবদ্ধতা থাকায় ঘণ্টা দুই পর ছেঁড়া দ্বীপ থেকে বিদায় নিলাম। সেন্ট মার্টিনে ফিরে এসে বিশ্রাম, দুপুরে খাবার শেষ করে বিকেলে জাহাজে আবার টেকনাফের উদ্দেশ্য যাত্রা। ফিরতি পথে আবারও সেই গাঙচিলের দেখা, কিন্তু এবার স্বাগত নয়, বিদায় সম্ভাষণ।

যখনই নতুন কোথাও যাওয়া হয়, সেই যাত্রার স্মৃতিগুলো আমি খুব যত্ন করে রেখে দিই আমার ল্যাপটপের নতুন একটি ফোল্ডার করে। বয়স বাড়ছে, বাড়ছে ফোল্ডারগুলো। যান্ত্রিক জীবনে দীর্ঘায়ুর আশা করাটা বেশ দুরাশা, তবে জীবনে যদি কখনো বার্ধক্য আসে, তখন হয়তো কর্মক্ষম থাকব না। আর নিষ্কর্মা এই মানুষকে হয়তো পরিবার, সমাজ ‘একঘরে’ করে দেবে। এই ‘একঘরে জীবনের’ স্মৃতির রোমন্থনের উপকরণ হয়ে থাকবে এই মুহূর্তগুলো।

*মো. আরাফাত রহমান, শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা।

**নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]–এ