সত্যেন বোসের বাগানবিলাস

সত্যেন বোসের দ্বিতীয় বাংলো। এখানে এখন মোকাররম হোসেন বিজ্ঞান ভবন। (ছবি: S N Bose : The Man and His Work Part II : Life, Lectures and Addresses, Miscellaneous Pieces,  S N Bose National Centre for Basic Sciences, Calcutta, 1994)

নভেম্বরের শুরু থেকেই কলকাতা শহরে বেশ শীত পড়েছে। সবকিছু গোছানো ছিল; গাড়ি আসতেই বেরিয়ে পড়লেন অধ্যাপক আনোয়ারুর রহমান খান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খান ইলেকট্রন-মাইক্রোস্কোপ সোসাইটির এক কনফারেন্সে যোগ দিতে সেবার ভারতে গিয়েছিলেন। কনফারেন্স ছিল বারানসিতে। সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার পথে কলকাতায় আসা। চালকের চেনা রাস্তা। বেশি সময় লাগল না। স্কটিশ চার্চ স্কুলের পাশে উত্তর কলকাতার এক গলি—ঈশ্বর মিল লেন। ২২ নম্বর বাড়ির সামনে এসে ড্রাইভার কাশীনাথ গাড়ি থামালেন। সাধারণ লালচে রঙের দোতলা বাড়ি। কাশীনাথ আশ্বস্ত করলেন, ‘হ্যাঁ, এটাই প্রফেসর বোসের বাড়ি।’ অধ্যাপক খান কড়া নাড়লেন, যুবক বয়সী এক ছেলে তাঁকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

নিতান্ত সাদামাটা বসার ঘরের এক পাশে কটা চেয়ার, অল্প কিছু আসবাব আর অন্য পাশে একটি খাট। সে খাটে শুয়ে আছেন অধ্যাপক সত্যেন বোস। তাঁর পরনে একটি লুঙ্গি, গায়ে হাফশার্ট আর তার ওপর একটা জাম্পার। সামনে এক থালা মুড়ি। এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা দশেক বিড়াল। অতিথির আগমনে উঠে বসলেন তিনি। অভিবাদন জানিয়ে বসতে বললেন। এরপর নানান প্রশ্ন, কবে ভারতে এসেছেন? কোথায় কোথায় গেলেন? কবে পাস করেছেন? বিদেশে কোথায় ছিলেন? কী বিষয়ে গবেষণা করছেন? প্রশ্ন আর কথার এই কয়েক মুহূর্তের আলাপে তিনি আপন করে নিলেন অধ্যাপক খানকে। এরপর এল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা প্রসঙ্গ।

জানতে চাইলেন, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তাঁর সময়কার কে কে আছেন? কাজী মোতাহার হোসেন, মতিন চৌধুরী, ইন্নাস আলী—সবার খোঁজখবর নিলেন। হঠাৎ কার্জন হলের পশ্চিম দিকে যে বাড়িটায় থাকতেন, সেটার কথা জানতে চাইলেন, ‘সেটা নাকি ভেঙে ফেলেছে?’ অধ্যাপক খান জানালেন, সে বাড়ি ভাঙা পড়েছে, সেখানে নতুন বিজ্ঞান ভবন উঠেছে। একটু যেন দমে গেলেন অধ্যাপক বোস। থেমে গিয়ে কিছু সময় পর দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন, কার্জন হলের পূর্ব দিকের বাড়ি প্রসঙ্গে। ‘ওটাও কি ভেঙে ফেলেছে?’ বললেন, ‘অনেক বোগেনভেলিয়ার গাছ লাগিয়েছিলাম, সেগুলো কি আছে?’ পুরু লেন্সের চশমার আড়ালে অধ্যাপক বোসের চোখ দুটিতে তখন ভাসছে ফেলে আসা ঢাকা, যেখানে সবুজ রমনার বুকে লাল ইটের এক দালানের ব্যালকনি বেয়ে উঠে গেছে রংবেরঙের বোগেনভেলিয়া বা বাগানবিলাসের ঝাড়।

বর্তমানে চামেরি হাউস
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকায় সত্যেন বোস

১৯২১ সালের কথা। সত্যেন বোস তখন কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রভাষক। পদার্থবিজ্ঞান আর ফলিত গণিত, এই দুই বিভাগে শিক্ষকতার চার বছর হয়ে গেছে। এ সময়ে প্রতিষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হার্টগ তখন নতুন সব বিভাগের জন্য শিক্ষক খুঁজছেন। কলকাতায় একদিন ডেকে পাঠালেন তরুণ সত্যেন বোসকে। ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে লেখা পত্রে নবগঠিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিডার পদে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেলেন বোস, বেতন ৪০০ টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে বোস তখন তেমন কিছু জানেন না।

শুধু জানেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে উঠছে মূল শহরের বাইরে, ঢাকার শহরতলিতে, বিশাল জায়গাজুড়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে যেমন শহরটা চারদিক থেকে চেপে ধরেছে, সে রকম কিছু ওখানে নেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের ১৯১৭-১৯-এর রিপোর্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশালতা বিষয়ে লিখেছে:
‘The Government of India desired that Dacca should be a model university of a type new to the Presidency and to India. We hope that it will serve-as such. Certainly in no other place in Bengal outside the metropolis are there greater opportunities for establishing a university which may serve as an example; and in some ways Dacca has even greater opportunities than those of Calcutta itself. The group of noble buildings, libraries and laboratories, the green playing fields with great spaces around them, uncramped by the crowded areas of a metropolis, will give to the young students of Bengal enviable opportunities to know the happy yet strenuous life enjoyed by so many university students in the 'island-universities' of the West. Dacca will be a small university compared to Calcutta, but it is to be remembered that many of the greatest of university teachers, have lived and worked in universities beside which Dacca will be large; and in many ways the opportunities of Dacca will be unique.”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর সময়ে সত্যেন বোস
ছবি: সংগৃহীত
গ্রুপ ছবিতে সর্বডানে উপবিষ্ট অধ্যাপক সত্যেন বোস, ছবিতে ‘বারোজনা’র সদস্যদের দেখা যাচ্ছে। (ছবি: সংগৃহীত)

চাকরির প্রস্তাবে রাজি হলেন বোস, হার্টগকে জানালেন, জুন মাস নাগাদ ঢাকায় যোগ দেবেন। পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ ছিল তাঁর জন্য সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। একালে কলকাতা থেকে ঢাকা বিমানে মাত্র আধঘণ্টার পথ হলেও, সেকালে যাতায়াত খুব সহজ ছিল না। রেলে চেপে গোয়ালন্দ নেমে স্টিমারে পার হতে হতো পদ্মা। দুই কূল ছাপানো জলরাশিতে পদ্মা নদী বোসকে আবেগাপ্লুত করে ফেলল।

কলকাতায় থাকাকালে প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্য মজলিশে যাওয়া হতো, মাঝেমধ্যে সে আসরে তিনি এসরাজও বাজাতেন। সময়-সুযোগ পেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যেতেন সেই আসরে, পদ্মাতীরে তাঁর পূর্ববঙ্গের জীবন নিয়ে গল্প করতেন। বহুদিনের সাধ ছিল সেই পদ্মা দেখার, অবশেষে তার দেখা মিলল। নদী পেরিয়ে নারায়ণগঞ্জ, সেখান থেকে আরেক রেলগাড়িতে চেপে বোস পৌঁছালেন ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশনে। এ শহরে তাঁর প্রথম ঠিকানা হলো চামেরি হাউস।

ঢাকায় নিজ বাগানে অধ্যাপক সত্যেন বোস এবং অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা (ছবি: S N Bose: The Man and His Work Part II : Life, Lectures and Addresses, Miscellaneous Pieces,  S N Bose National Centre for Basic Sciences, Calcutta, 1994)

বঙ্গভঙ্গের সূত্রে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন প্রদেশ গঠনের পর রমনা গ্রিনের এক প্রান্তসীমায় গড়ে উঠেছিল চামেরি হাউস নামের এই বাংলো। ইংরেজ কটেজ হাউসের অনুকৃতি বাংলোটি বরাদ্দ ছিল অবিবাহিত ইংরেজ সিভিলিয়ানদের মেস হিসেবে। যে কারণে ইংরেজি ‘চাম’ (Chum) শব্দ থেকে এর নামকরণ করা হয় চামেরি হাউস (Chummery House)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরপর এটিকে শিক্ষকদের আবাসিক ভবন হিসেবে বরাদ্দ করা হয়। পুষ্পবৃক্ষাচ্ছাদিত চামেরি হাউসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বোস প্রথমবারের মতো ঢাকাকে দেখলেন। ব্যালকনির দুই ধার বেয়ে উঠে গেছে অপরাজিতা, তার সঙ্গে মিশেছে হংসলতা আর ঝুমকোলতার ঝাড়। সামনের বাগানের এক পাশে বিলেতি পামগাছ আর অন্য পাশে অশোক, বকুল, শিরীষ আর কৃষ্ণচূড়ার সারি। আর এসব ছাড়িয়ে যত দূর চোখ যায়, কেবলই সবুজের সমারোহ—বোস মুগ্ধ হলেন। বঙ্গভঙ্গের পর রেললাইনের উত্তরে বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তরজুড়ে গড়ে ওঠা নতুন ঢাকাকে দেখে মুগ্ধ হননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। লন্ডনের কিউ উদ্যানের রবার্ট লুইস প্রাউডল শহরকে নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছিলেন। দীর্ঘ প্রশস্ত কালো পিচের রাস্তার দুই পাশজুড়ে ছায়া দেওয়া দেশি-বিদেশি বৃক্ষের সারি, রমনার মাঝখানটা জুড়ে দিঘি, সেই দিঘিতে হরেক শাপলা আর আমাজন লিলির সমাগম আর মধ্যে বিশাল জায়গাজুড়ে মোগল ধাঁচে তৈরি কার্জন হল, গম্বুজওয়ালা গভর্নমেন্ট হাউস কিংবা শ্বেতশুভ্র সেক্রেটারিয়েটের মতন রাজকীয় ভবন—এসব মিলিয়ে ঢাকা হয়ে উঠেছিল ‘ভেতরে-বাইরে জমকালো’ এক শহর। বঙ্গভঙ্গ রদ এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এর অনেকগুলো ভবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারে আসে। সে সময়কার ঢাকা বিষয়ে কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিচারণা, ‘স্থাপত্যে কোনো একঘেয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়াদিল্লির জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি।…সর্বত্র প্রচুর স্থান, ঘেঁষাঘেঁষি ঠেলাঠেলির কোনো কথাই ওঠে না।’

কার্জন হলের সামনে তোলা ছবিতে সত্যেন
ছবি: সংগৃহীত

কাজে যোগ দেওয়ার পর অবশ্য প্রথম দিনের মুগ্ধতা খানিকটা হোঁচট খেল। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার যন্ত্রপাতি আর বইপত্র, সাময়িকীর অপ্রতুলতা প্রকট। বন্ধু মেঘনাদ সাহা ঢাকার ছেলে। তাঁকে এক চিঠিতে জানালেন যে যন্ত্রপাতি, যেমন নিকল প্রিজম, লেন্স, আইপিস ইত্যাদি যদিও অনেক আছে, কিন্তু সঠিক ব্যবহারের অভাবে সব নষ্ট হতে বসেছে। তবে দমে যাওয়ার মানুষ তো তিনি নন। জানালেন, নিজেই সেসব যন্ত্রপাতি ঠিক করার জন্য পড়ালেখা শুরু করেছেন আর বিশ্ববিদ্যালয়কে জানিয়েছেন নতুন সব গবেষণা সাময়িকীর কথা। কর্তৃপক্ষ তাঁকে আশ্বস্ত করেছে সেসবের বিষয়ে, সঙ্গে জানিয়েছে বিজ্ঞানের পৃথক পাঠাগার তৈরির কথা। কার্জন হল তখন বিজ্ঞান ভবন, নতুন তৈরি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগটিও সেখানে। এর বিভাগীয় প্রধান তখন অধ্যাপক জেঙ্কিনস, সঙ্গে আছেন সত্যেন বোস, আর এন ঘোষ এবং কাজী মোতাহার হোসেন। স্নাতক আর স্নাতকোত্তর—দুই পর্যায়েরই ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। বোস পড়ান স্নাতকোত্তর ক্লাসে, থার্মোডাইনামিকস আর ম্যাক্সওয়েলের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তত্ত্ব। ক্লাসের বাইরে বাকিটা দিন কেটে যায় ভবনের পশ্চিম পাশের নিচের তলায়, গবেষণাগারে। সেখানে এক আলাদা জগৎ। অন্ধকার ঘরটিতে দিনের বেলাতেও বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এ সময় প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে তাঁর ব্যস্ত সময় কাটে। ক্ল্যাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তেজস্ক্রিয়তা নীতি প্রতিপাদন করে একটি গবেষণা নিবন্ধ রচনা করলেন বোস। নিবন্ধটি বিলেতের Philosophical Magazine-এ প্রকাশ করার প্রাথমিক চেষ্টা ব্যর্থ হলো। বোস হাল ছাড়ার লোক নন, তিনি সে লেখা সরাসরি পাঠিয়ে দিলেন আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে। সুদূর ঢাকার নবগঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নাম না জানা রিডারের প্রজ্ঞা ও যৌক্তিক বিশ্লেষণে আইনস্টাইন মুগ্ধ হলেন। নিবন্ধটি নিজেই জার্মান ভাষায় অনুবাদ করলেন, সে সময়ের সেরা এক গবেষণা সাময়িকী Zeitschrift für Physik-তে প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন। সঙ্গে জুড়ে দিলেন নিজের ছোট্ট নোট: In my opinion Bose's derivation signifies an important advance. The method used here gives the quantum theory of an ideal gas as I will work out elsewhere. মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের এই স্বীকৃতি বোসকে ইউরোপের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সেরা সব গবেষণাগারে কাজের সুযোগ এনে দিল। ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে তিনি পৌঁছালেন প্যারিসে। ইউরোপে দুই বছর অবস্থানকালে তিনি মেরি কুরি এবং আইনস্টাইনের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কাজের সুযোগ পেলেন। ১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বরে ফিরলেন ঢাকা। ইতিমধ্যে জেঙ্কিনস ঢাকা ত্যাগ করেছেন, অধ্যাপকের পদ খালি হয়েছে। বন্ধুরা বোসকে পরামর্শ দিলেন আবেদন করার। অধ্যাপক পদে ডক্টরেট ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার ছিল। আবার এগিয়ে এলেন আইনস্টাইন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বোসের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। সত্যেন বোস রিডার থেকে অধ্যাপক পদে উন্নীত হলেন, সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বও লাভ করলেন। নতুন দায়িত্বের সঙ্গে যোগ হলো নতুন সুযোগ-সুবিধা; কর্মস্থলের কাছেই কয়েক বিঘা জায়গাজুড়ে দোতলা এক বাড়ি বরাদ্দ হলো অধ্যাপক বোসের নামে।

সেই বাড়ি, সেই বাগান

বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে ইংরেজ অফিসারদের জন্য তৈরি বাড়িগুলো এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারে, তার বেশ কয়েকটি বরাদ্দ হয়েছিল অধ্যাপকদের আবাস হিসেবে। দেশি, মোগল আর ইংরেজ রীতির মিশ্রণে বাড়িগুলো তৈরি হয়েছিল। এ দেশের জলভেজা আবহাওয়ায় সহজ রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল। বছর বছর রেড অক্সাইডের প্রলেপে সেই বাড়ি হয়ে উঠত ঝকঝকে নতুন। প্রায় প্রতিটি বাড়ির চারদিকে ৪-৫ বিঘা জমি, সামনে সবুজ লন, পেছনে বাগান; ভারতের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা এমন আবাস কল্পনাও করতে পারেন না। চুনসুরকি আর লাল ইটের গাঁথুনিতে তৈরি তোপখানা সড়কের সে রকম এক দোতলা বাড়িতে সপরিবার উঠে এলেন অধ্যাপক সত্যেন বোস। কাঠের গেট পেরিয়ে গালিচাসদৃশ সবুজ লন, বাড়িতে ঢুকতে বিশাল হলঘর, হলঘর পেরিয়ে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। একতলা-দোতলাজুড়ে তিন সন্তানের ছোটাছুটি আর নিত্য অতিথির সমাগমে বাড়িটি প্রাণ পেল। প্রতি সকালে ধীর পায়ে কার্জন হলের উদ্দেশে বেরিয়ে যান অধ্যাপক বোস; চুল তাঁর উষ্কখুষ্ক, পরনে খাকি প্যান্ট-শার্ট, বোতামের ঠিক নেই, আর হাতে গোল্ডফ্লেকের টিন। বিভাগীয় প্রধানের কক্ষে কিংবা গবেষণাগারে সময় কেটে যায়। নিজ কক্ষে সারি ধরে চেয়ার রাখা। সারা দিন ছাত্রদের সমাগম, কাউকে ফেরান না তিনি। একাডেমিক বিষয় তো থাকেই, কেউ আর্থিক সমস্যায় পড়লে প্রয়োজনে নিজে ধার করে এনে সাহায্য করেন। দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে। গবেষণাগারে হয়তো কোনো ছাত্র ফল মেলাতে পারছে না; ছুটে যান সত্যেন বোস, ‘দেখি, তোর রেজাল্টের খাতাটা দে তো।’ রাত হয়ে যায়, কিন্তু ছাত্রের কাজ শেষ না করে তিনি বাড়ি ফেরেন না। সহকর্মীদের বিপদে-আপদেও সবার আগে এগিয়ে আসেন তিনি। উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক পুণ্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের মাঝেমধ্যে মাথার গোলমাল দেখা দেয়। তখন তাঁকে নিজ বাড়িতে রেখে সব রকম যত্ন নেন অধ্যাপক বোস।

বাড়িতে অতিথির আনাগোনা লেগেই থাকে। ড. মেঘনাদ সাহা নিয়মিত আসেন পরীক্ষক হিসেবে। এর মধ্যে চাকরিসূত্রে ঢাকায় বদলি হন অন্নদাশংকর রায়। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান—নানা বিষয়ে জ্ঞানভিত্তিক আড্ডার জন্য গড়ে তুলেন ‘বারোজনা’। অধ্যাপক সত্যেন বোসসহ মুহম্মদ হুসেইন, সতীশরঞ্জন খাস্তগীর, আর্থার হিউজ, ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সদস্যের সে আসর সময়ে সময়ে মিলিত হতো সত্যেন বোসের বাড়িতে। সংগীতের প্রতি বোসের আশৈশব আকর্ষণ। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শিল্পীদের নিয়ে তিনি নিয়মিত জলসার আয়োজন করতেন। আর বাড়িতে এসব আয়োজনের শেষে বোস বাজাতেন নিজের এসরাজখানা। কিশোরবেলা থেকেই তিনি এসরাজবাদন রপ্ত করেছিলেন। প্রিয় এসরাজটিতে যখন সুর তুলতেন, তখন তিনি হারিয়ে যেতেন দৃষ্টিলোকের বাইরের কোনো জগতে। আগত অতিথিরা সম্মোহিত হয়ে শুনতেন সেই অপরূপ সুরধ্বনি।

কলকাতার ঈশ্বর মিল লেনে সত্যেন বোসের বাড়ি
ছবি: সংগৃহীত

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সমর গুহ জন্মেছিলেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। রমনার সেই বাড়িতে বোসের জলসা বিষয়ে অধ্যাপক সমর গুহ স্মৃতিচারণা করেছেন, ‘জ্যোৎস্না রাতে অধ্যাপক বসুর হাতে খেলে যেত এসরাজের ছড়িটি। ফুলে ফুলময় তার ঢাকার রমনার বাড়িতে এই যন্ত্রসংগীত যে শুনেছে এবং বিজ্ঞানাচার্যের শিল্পী আবেগোচ্ছল মূর্তি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা সে কথা ভুলতে পারবেন না। ঢাকাতে প্রতিবছর নামকরা গাইয়ে-বাজিয়ে আমন্ত্রিত হতেন। তাঁদের কেউ অধ্যাপক বসুর বাগানঘেরা আঙিনার জলসায় উপস্থিত না হয়ে সহজে ঢাকা ত্যাগ করতে পারতেন না।’
সেকালের ঢাকাবাসীর লেখায় সত্যেন বোসের ফুলে ফুলে ঢাকা বাগানটির কথা এসেছে বারবার। কলকাতার ইটপাথরের দালানে এমন বাগান করার সুযোগ ছিল অকল্পনীয়। ঢাকার রমনীয় রমনার বিশালতার মধ্যে সযত্নে বাগানটি গড়ে তুলেছিলেন বোস। লেখক প্রতিভা বসু (বিয়ের আগে রানু সোম), বাবা আশুতোষ সোমের সঙ্গে তাঁদের বনগ্রাম লেনের বাসা থেকে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে প্রায়ই চলে আসতেন অধ্যাপক বোসের বাড়িতে। আবার সে বাড়ির গানের আসরেও তিনি ছিলেন নিয়মিত শিল্পী। আত্মজীবনী ‘জীবনের জলছবি’তে লিখেছেন সেই দিনগুলোর কথা: ‘সত্যেনদার খুব ভোরে ওঠা অভ্যাস। মালীদের সঙ্গে বাগান করেন। সত্যেনদার বাগান দারুণ বাগান। রমনাপাড়ায় সবচেয়ে সুন্দর বাগান। আমরা গেট খুলে ঢুকতেই আমাদের দেখে ঘাস তোলা নিড়ানি ফেলে এগিয়ে এলেন…সত্যেনদার বাগানে বেঁটে বেঁটে কলাবতী ফুলের গাছে কী সুন্দর ফুল ফুটেছিল যে বলা যায় না। ওরকম বেঁটে কলাবতী কোনো দিন দেখিনি। ওরকম বাগান আলো করা অত ফুল একসঙ্গে কখনো দেখিনি। আমি মুগ্ধ।’ প্রতিভা বসুর মুগ্ধতা আপ্লুত করেছিল অধ্যাপক বোসকেও। কয়েক দিন পর নিজেই কলাবতীগাছ কাঁধে চাপিয়ে হেঁটে হেঁটে হাজির হন প্রতিভা বসুর বাসায়। তিনি লিখেছেন, ঝুরঝুরে মাটিতে ছেয়ে গেছে পাঞ্জাবির পিঠ, তা নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এসেই গাছগুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও তোমার গাছ নাও।’

সহকর্মী ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে সত্যেন বোসের ঘনিষ্ঠতা ছিল পারিবারিক পর্যায়ে। বাবা মোতাহার হোসেনের সঙ্গে সাইকেলে চেপে কন্যা যোবায়দা মির্জা বহুবার গিয়েছেন সেই বাড়িতে। ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’ বইটিতে পরম মমতায় সেসব স্মৃতিচারণা করেছেন তিনি। লিখেছেন, ফ্রক পরা দিনগুলোতে বাবার সহকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে বেড়ানোর কথা। শৈশবস্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে সেসব বাড়ির আপ্যায়নের কথা—সন্দেশ, নাড়ু, মোয়া, বরই কত কী! লিখেছেন, ‘এখন যেটা প্রেসক্লাব, সেখানে থাকতেন প্রফেসর সত্যেন বোস। তার মেয়েরা আমাদের সঙ্গে পড়ত। বাড়িটা সম্পূর্ণ ফুলে ফুলে ঢাকা ছিল। বড় বড় গাছগুলো থেকে আরম্ভ করে ছাদ পর্যন্ত নানা রঙের বাগানবিলাস, মাধবী, মালতি, হাসনাহেনা, আরও কত ফুল বর্ণ ও সুগন্ধি ছড়িয়ে যেন স্বপ্নপুরী সৃষ্টি করত।’

ভেঙে ফেলার আগে তোলা ছবিতে সত্যেন বোসের বাড়ি। এটি তখন জাতীয় প্রেসক্লাব ভবন
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই যুগের বেশি কাল যুক্ত থাকার পর ১৯৪৫ সালে সত্যেন বোস যোগ দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠানো তারিখবিহীন এক লাইনের এক চিঠিতে ১৯৪৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ঢাকা হলের প্রভোস্ট পদে ইস্তফা দেন সত্যেন বোস। এখানে উল্লেখ করা যায়, ১৯৩৯ সালে প্রভোস্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর হলের নিকটে থাকার প্রয়োজনে বোস তোপখানা সড়কের বাড়িটি ছেড়ে কার্জন হলের কাছে বর্তমান মোকাররম হোসেন বিজ্ঞান ভবনের স্থানে এক বাংলোতে চলে আসেন। সত্যেন বোসের ঢাকা ত্যাগের পর এই বাংলোতে থেকেছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক পঞ্চানন মহেশ্বরী। আফ্রিকান ওক আর গগনশিরীষে ঘেরা বাংলোটিতেও মাধুরিলতা, জুঁই, ঝুমকোলতার চমৎকার বাগান ছিল।
তোপখানা সড়কের সেই বাড়ি আর সংলগ্ন বাগান মুগ্ধ করেছিল কবি বেলাল চৌধুরীকে। তিনি অবশ্য যে সময়ের কথা লিখেছেন, তত দিনে দেশভাগ হয়ে গেছে। ১৯৫৪ সালে বাড়িটি বরাদ্দ হয় প্রেসক্লাবের নামে। তবে বাড়িটির জৌলুশ তখনো বিদ্যমান, ‘…প্রায় সব ঋতুতেই লাল ইটের বাড়িটিকে সকালে সোনা রঙের কোমল আলো বা বিকেলের পড়ন্ত রোদে এক ধরনের সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত করে তুলত। সর্বোপরি আশপাশের ঝাঁকড়া মাথা বিশাল বিশাল মেঘশিরীষের গাছ আর চারপাশের পরিবেশের সঙ্গেও বেশ মানিয়ে গিয়েছিল।’

পরিশিষ্ট

অধ্যাপক আনোয়ারুর রহমান খান অধ্যাপক বোসের সঙ্গে দেখা করেন ১৯৭৪ সালে। তত দিনে বোসের লাগানো বাগানবিলাসের গাছগুলো কাটা পড়েছে। সে বাড়ির কাছে বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনের গোলচত্বরে ছিল বিভিন্ন জাতের বাগানবিলাসের এক বিশাল ঝাড়। প্রতি বসন্তে সেখানে রঙের মেলা বসত। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে সেই বাগানবিলাস উপড়ে ফেলে বসানো হয় ফোয়ারা। আর সত্যেন বোসের স্মৃতিঘেরা সেই লাল বাড়িটি! ১৯৭৯ সালে বাড়িটি ভেঙে গড়ে ওঠে জাতীয় প্রেসক্লাবের নতুন ভবন। ঢাকার বুক থেকে চিরকালের মতন হারিয়ে যায় সত্যেন বোসের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিচিহ্ন।

লেখক: অধ্যাপক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সহায়ক সূত্র:
১. আচার্যের সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ, আনোয়ারুর রহমান খান, মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকী, এপ্রিল, ১৯৭৪
২. পঞ্চাশ বছরের সাংবাদিকতা জাতীয় প্রেসক্লাব, সুবর্ণ জয়ন্তী প্রকাশনা, সম্পাদনা: হাসান হাফিজ, ২০০৪