‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক’ পত্রিকার সম্পাদকের মৃত্যুবার্ষিকী

মীজানুর রহমান।
ছবি: সংগৃহীত

মীজানুর রহমান। একটি প্রতিষ্ঠান। একজন সুসাহিত্যিক ও খ্যাতিমান সম্পাদক। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিকের নাম শোনেননি এমন সাহিত্যবোদ্ধা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই দুঃসাহসী মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০০৫ সালের ২৬ জুন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তিনি সব সময় মনে করতেন একটা অর্থপূর্ণ কাজ না করতে পারলে শুধু শুধু বেঁচে থেকে কী লাভ। তাই নিজে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন তাঁর কর্মে, চিন্তায়, চেতনায়।

স্বপ্নবান মানুষটি নিজের জীবনকে সততার সঙ্গে উৎসর্গ করে গেছেন। তাঁকে কি আমরা সেইভাবে মনে রেখেছি। বা কতটুকু তাঁর সম্পর্কে আমরা জেনেছি।

সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের আকুলতায় নিজের আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। একটি উচ্চমানের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করা কী যে ভীষণ কষ্টদায়ক, তা শুধু সম্পাদকই জানেন। মীজানুর রহমান সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করলেন নিজ নামে। এর কারণ ‘সম্পাদকসর্বস্ব’। আহমদ মাযহার মীজানুর রহমান স্মরণে লিখেছেন—‘সম্পাদকসর্বস্ব’ কথাটির মধ্যে একটু কটুভাব আছে। মনে হতে পারে শ্লেষ করা হচ্ছে কথাটির মধ্য দিয়ে। কিন্তু অনেক সময় এমন হয় যে শ্লেষটাই হয়ে-ওঠে যথার্থ অভিধা। কারণ কী ছিলেন না মীজানুর রহমান তাঁর পত্রিকাটির। তিনি নিজে যেমন ছিলেন পরিকল্পক, তেমনই ছিলেন লেখা সংগ্রাহক, প্রুফ-সংশোধক, অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা পিয়ন, চা পরিবেশনকারী বা পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কুলি কিংবা কর্মাধ্যক্ষ বা চিত্রশিল্পী কোনো দায়িত্বটি তিনি পালন করেননি! সুতরাং এমন একব্যক্তিসর্বস্ব, একটি পত্রিকার নাম তো সেই ব্যক্তির নামেই হতে হবে! ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের যুগে হিকি সাহেব পত্রিকা বের করেছিলেন নিজের নামেই! ‘হিকিস গেজেট’ নামটা শুনলে অস্বস্তি লাগে না, কিন্তু মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক শুনলে অস্বস্তি হয় কেন? পত্রিকার এ রকম নামকরণের হ্যাপা তাঁকে কয়েক বছর ভোগ করতে হয়েছে। নামকরণের এই বাস্তবতাকে ঢাকার পাঠকসমাজের মানতে কয়েক বছর লেগে গিয়েছিল। এ নিয়ে তাঁর নিজের অবশ্য কোনো অস্বস্তি ছিল না। কারণ হিসেবে তিনি জানালেন সম্পাদকের নামেই পত্রিকার নাম নতুন কোনো ব্যাপার নয়। ‘হিকিস গেজেট’ তো বাংলায় সেই উনিশ শতকের নিদর্শন। তুলনায় হাল আমলে, এই সেদিন বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকেও ছিল ‘রমাপদ চৌধুরীর পত্রিকা’ নামে একটি পত্রিকা।

ভাবতে খুব অবাক লাগে যখন দেখি, মীজানুর রহমান এমনই একজন সম্পাদক যিনি কি না শত শত পৃষ্ঠা নিজেই সম্পাদনা, বানান, অলংকরণ, লেখা সংগ্রাহক সব একাই করতেন। যা আমাকে অনুপ্রাণিত করে। সংখ্যাগুলো বেশ তাৎপর্যমূলক। প্রতিটি সংখ্যা ছিল ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে। কখনো তিনি করতেন ব্যক্তি বা কোনো বিশেষ বিষয় নিয়ে।

যেমন উল্লেখ করা যেতে পারে—নদী সংখ্যা, পক্ষী সংখ্যা, বৃক্ষ সংখ্যা, গণিত সংখ্যা কিংবা কৃষ্ণদয়াল বসু সংখ্যা, কামরুল হাসান সংখ্যা, রশিদ চৌধুরী সংখ্যা, শামসুর রাহমান সংখ্যা।

২.
সুসাহিত্যিক ত্রৈমাসিক সম্পাদক হিসেবে খ্যাত মীজানুর রহমান ১৯৩১ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি বর্তমান মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর পরগনার ইছামতী নদীর তীরে টোল বাসাইল গ্রামে এক পীরালি পীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন খন্দকার ফজলুর রহমান (১৮৯৮-১৯৮৪) এবং মা কাজী খুরশিদা খাতুন (১৯০৯-১৯৯২)। নয় ভাই-বোনের মধ্যে (তিন ভাই ও ছয় বোন) মীজানুর রহমান ছিলেন ভাইদের মধ্যে মধ্যম। জন্মের পরপর তিনি বাবার কর্মস্থল চলে যান। সেখানেই সেন্ট পলস কলেজসংলগ্ন চ্যাপেল গার্লস স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯৪০ সালে মিত্র ইনস্টিটিউশনে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন।

স্কুলজীবন থেকে শুরু হয় পত্রিকা সম্পাদনার কাজ। ১৯৪৬ সালে মিত্র ইনস্টিটিউশনে হাতে লেখা কিশোর পত্রিকা মুয়াজ্জিন–এর সম্পাদক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। একই সঙ্গে লিপিকর-চিত্রকর হিসেবেও ওই পত্রিকাতেই আত্মপ্রকাশ। স্কুলের খাতায় লিখে প্রচ্ছদ বানিয়ে বইয়ের আকারে প্রকাশিত এ পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো, যার পাঠক ছিল মীজানুর রহমানের স্কুলের বন্ধুরা।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাবার সঙ্গে পাকিস্তানে থেকে পূর্ব পাকিস্তান (এখন বাংলাদেশ) চলে আসেন। ১৯৪৮ সালে বিশেষ ব্যবস্থায় মিত্র স্কুল থেকে নবম শ্রেণির পরীক্ষার খাতা ও প্রশ্নপত্র আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।

আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সে সময়কার প্রধান শিক্ষক শামসুদ্দীন আহমদের অধীনে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি আরমানিটোলা স্কুলে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় এবং ১৯৫১ সালে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর প্রথমে জগন্নাথ কলেজে আর্টস বিভাগে ভর্তি হলেও পরে আঁকাআঁকিতে আগ্রহ থাকায় সিদ্ধান্ত বদল করে ঢাকা আর্ট কলেজে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউট) ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে চারুকলার অধ্যয়ন ত্যাগ করে আবার জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

৩.
স্কুলজীবনে সম্পাদক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৪৬ সালে। সেই সঙ্গে কলকাতার ‘ইত্তেহাদ’, ‘আজাদ’ ও ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় তাঁর আঁকা কার্টুন প্রকাশিত হতো। দেশে আসার পর ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবীবুল্লাহ বাহার, শিক্ষাবিদ ও নারীশিক্ষার অগ্রদূত শামসুন্নাহার মাহমুদ প্রমুখের বাণীসমৃদ্ধ হয়ে হাতে লেখা পত্রিকা ‘মুয়াজ্জিন’ পরিবর্তিতরূপে পাকিস্তানের প্রথম কিশোর মাসিক পত্রিকা ‘ঝংকার’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। পত্রিকার তখন লিখতেন সেই সময়ের বিখ্যাত লেখকেরা—পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীন, আহসান হাবীব, রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই), আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মোহাম্মদ নাসির আলী, মবিনউদ্দিন আহমদ, আবদুল্লাহ আল–মুতী শরফুদ্দীন, ফয়েজ আহমদ, বদরুল হাসান (ছড়াকার), আশরাফ সিদ্দিকী, রওশন উজদানী, হাবীবুর রহমান প্রমুখ। ১৯৫১ সালেই ‘ঝংকার’ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৫১ সালে মীজানুর রহমান রম্য, সাহিত্য ও বিনোদনমূলক মাসিক পত্রিকা ‘রূপছায়া’র সম্পাদনা ও প্রকাশনা শুরু করেন। এটি বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) প্রথম সিনেমা পত্রিকা। পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে তাঁর অগ্রজ মঈদ-উর-রহমান কিছুকাল যুক্ত ছিলেন। বিশেষ সংখ্যা হিসেবে পত্রিকাটির প্রেম সংখ্যা, ভৌতিক সংখ্যা, বিজয় দিবস সংখ্যা সে সময় অনেকের প্রশংসাধন্য হয়েছিল। ১৯৫২ সালে মাসিক রূপছায়ার প্রেম সংখ্যায় সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘এক মহিলার ছবি’ প্রথম প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকার বিজয় দিবস সংখ্যায় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে মাসিক ‘রূপছায়া’ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রাম শাখার বার্তা বিভাগে সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করে চট্টগ্রাম চলে যান।

User

৪.
ব্যক্তিগত জীবনে মীজানুর রহমান ১৯৬৩ সালের ১৮ জানুয়ারি লুৎফা খানমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। কিন্তু ১৯৬৩ সালের ২৭ নভেম্বর যমজ পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে স্ত্রীর অকালপ্রয়াণ ঘটে। এর ১১ দিন পরে দ্বিতীয় পুত্রের মৃত্যু হয়। পরে ১৯৬৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর নূরজাহান বেগম বকশীকে বিয়ে করেন।

৫.
মীজানুর রহমানের জীবদ্দশায় তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে ঢাকার দিদার পাবলিশিং হাউস থেকে রক্তপিছল কাশ্মীর (একটি রাজনৈতিক সমীক্ষা)। এটি তাঁর পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ, ১৯৮৪ সালে ঢাকা সাহানা থেকে অনুবাদের বই কাকাতুয়া। এটি মলিয়ের রচিত ল্যে প্রেসিওজ রিডিকিউল নাটকের অনুবাদ। প্রচ্ছদ করেছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান। ১৯৯১ সালে সাহানা থেকে প্রকাশিত হয় স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ কমলালয়া কলকাতা, সেই বইটির প্রচ্ছদ করেন সৈয়দ ইকবাল ও অলংকরণ করেন তিনি নিজেই। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো নিয়ে ২০১১ সালে প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয় ‘ঢাকা পুরাণ’। এটি প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেন রফিকুন নবী।

তাঁর গদ্য সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওয়াহিদুল হক যথার্থই বলেছেন, …তাঁর ভাষাটি…যেন বাংলার আবহমান কালের সোঁদা মাটি আর বনবাদাড় থেকে সংগ্রহ করেছেন—কত যে প্রাকৃত শব্দ, তাদের অধিকাংশের উপস্থিতি নেই অভিধানে। কিন্তু পড়ামাত্র জেনে যাই কী বোঝায় তা। কোনো অঞ্চল বিশেষের সম্পদ কি তা? না, বাঙালিত্বের সবটা জেনে এই শব্দসম্ভার এই প্রয়োগরীতি দাঁড়িয়েছে। কোনো সীমাটানা শব্দ নেই, যেমন হিন্দু শব্দ, মুসলমান শব্দ, নেই কোনো কালের কিংবা অঞ্চলের সীমাদ্যোতক শব্দও। খুবই একটা উদারবিস্তার, প্রাচীন শক্ত জমির উপর দাঁড়িয়ে মীজান লেখেন, ভাবেন, কাজ করেন, সকলকে সেই জমিটিতে আহ্বান করেন। [রোদ্দুর, সংখ্যা ৭, ১৯৯৭, সম্পাদক: লতিফ সিদ্দিকী ]

এমন নিষ্ঠাবান সম্পাদক, সাহসী সাহিত্যিক আমাদের মাঝে চিরন্তন বেঁচে থাকবেন, যত দিন বাংলা সাহিত্য বেঁচে থাকবেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।

আবু সাঈদ: সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ’৭১