মা, মানুষ গড়ার কারিগর

টমাস আলভা এডিসন ও তাঁর মা ন্যান্সি এডিসন
ছবি: সংগৃহীত

একজন শিশুর বেড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কে? নিঃসন্দেহে তার ‘মা’। মায়ের সঙ্গে সন্তানের এ সম্পর্ক আত্মিক। এ কারণে, একজন মা তাঁর সন্তানকে যতটা ভালোভাবে বুঝতে পারেন, তেমনি করে পারেন না অন্য কেউ। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার অনেক আগে থেকে, অর্থাৎ মায়ের গর্ভে ধীরে ধীরে যখন শিশুটি বেড়ে ওঠে, তখন থেকেই তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় মায়ের। গবেষণায় এ বিষয়টা প্রমাণিত যে শিশু তার জন্মের আগে থেকেই অনেক কিছু শিখতে শুরু করে; গর্ভাবস্থায় শ্রবণ, গন্ধ, স্বাদ ইত্যাদি অনুভূতি তৈরি হতে থাকে মায়ের মাধ্যমে। পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপিত হয় মায়ের দ্বারা। জন্মের পর পরম মমতায় যিনি শিশুকে বুকে তুলে নেন, তিনি আর কেউ নন, মা। সন্তান লালন-পালনের গুরুদায়িত্ব নিঃস্বার্থভাবে পালন করেন তিনি। সবচেয়ে কাছ থেকে, সবচেয়ে অধিক সময় এবং সবচেয়ে বেশি মমতা একটি শিশু পায় তার মায়ের কাছে।

মায়ের হাত ধরে শিশু তার জীবনের অনেক কিছুর সঙ্গেই প্রথম পরিচিত হয়। স্বাভাবিক কারণে, মা হয়ে ওঠেন একটি শিশুর প্রথম এবং সবচেয়ে ভালো শিক্ষক। দেখা যায়, এমন অনেক সূক্ষ্ম বিষয় আছে, যা হয়তো কেবল মায়ের নজরে পড়ে, অন্যরা ঘুণাক্ষরেও তা কল্পনা বা উপলব্ধি করতে পারেন না। এ নিয়ে আছে অসংখ্য দৃষ্টান্ত। প্রসঙ্গক্রমে, দুটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে।

প্রথমটি, পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনকে নিয়ে। একদিন শিশু টমাস স্কুল থেকে ফিরে তার মাকে একটা চিঠি দিয়ে বলল, ‘স্যার বলেছেন, এই চিঠিটা আমি যেন শুধু তোমার হাতেই দিই।’ চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন তার মা। টমাস লক্ষ করল, অশ্রুসজল হয়ে গেছে মায়ের দুচোখ। সে জানতে চাইল, কী লেখা আছে চিঠিটায়? মা তখন তাকে শুনিয়ে পড়লেন, ‘আপনার সন্তান অত্যন্ত মেধাবী। ওকে পড়ানোর মতো অত ভালো শিক্ষক আমাদের এই ছোট্ট স্কুলে নেই। অনুগ্রহ করে বাড়িতে আপনি ওকে পড়াবেন।’

টমাস একদিন বাড়ির পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে চিঠিটা পান, যাতে লেখা ছিল, ‘আপনার ছেলে ভীষণ বোকা। আমাদের পক্ষে ওকে আর স্কুলে রাখা সম্ভব নয়।’ চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ চিৎকার করে কাঁদলেন টমাস। তারপর তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন, ‘টমাস আলভা এডিসন ছিল ভীষণ বোকা, স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন এক বালক, যে কিনা শতাব্দীর সেরা প্রতিভাবান হয়ে ওঠে শুধু একজন অসাধারণ মায়ের শিক্ষায়।’
মা–বাবার সঙ্গে উইলমা রুডলফ
ছবি: সংগৃহীত

তারপর, অনেক দিন পার হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে বিদায় নিয়েছেন টমাসের মমতাময়ী মা। আর তত দিনে শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানীর স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন তিনি। একদিন বাড়ির পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে তাঁর হাতে পড়ে সেই চিঠিটা, যাতে লেখা ছিল, ‘আপনার ছেলে ভীষণ বোকা। আমাদের পক্ষে ওকে আর স্কুলে রাখা সম্ভব নয়।’ চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ চিৎকার করে কাঁদলেন টমাস। তারপর তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন, ‘টমাস আলভা এডিসন ছিল ভীষণ বোকা, স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন এক বালক, যে কিনা শতাব্দীর সেরা প্রতিভাবান হয়ে ওঠে শুধু একজন অসাধারণ মায়ের শিক্ষায়।’

কৌতূহলী মন জানতে চায়, কী এমন শিক্ষা টমাসের মা ন্যান্সি এডিসন তাঁর সন্তানকে দিয়েছিলেন যার কারণে, টমাস পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী হয়ে ওঠেন? প্রথমত, সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস আর আস্থা। তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন, তাঁর ছেলে একদিন অনেক বড় মানুষ হবেন। প্রতি মুহূর্তে তিনি টমাসকে তাই উদ্বুদ্ধ করতেন। টমাসের মা লক্ষ করেছিলেন, বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি তাঁর ছেলের ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। যেকোনো বিষয়ে পড়াশোনা বা জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে তিনি সব সময় তাঁর ছেলেকে উৎসাহিত করতেন। শিশু বয়সেই টমাসকে বই পড়ায় বিশেষ আগ্রহী করে তোলেন তিনি। এর পাশাপাশি, অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ করার জন্য জোগাতেন সাহস আর অনুপ্রেরণা। টমাস এডিসন তাঁর জীবনে মায়ের অনন্য ভূমিকার কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার মা আমাকে তৈরি করেছিলেন। তিনি আমার ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত আর আশাবাদী ছিলেন যে আমার সব সময় কেবল মনে হতো পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ আছেন, যাঁর জন্য আমাকে বেঁচে থাকতে হবে, আর কখনোই আমি তাঁকে আশাহত করতে চাইতাম না।’

বিশ্বখ্যাত ক্রীড়াবিদ উইলমা রুডলফের বিখ্যাত হয়ে ওঠার গল্পটাও হৃদয়স্পর্শী। একজন মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, পরম যত্ন এবং সন্তানের প্রতি আস্থার কারণে প্রায় পঙ্গু এক শিশু হয়ে ওঠে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১৯৬০–এর অলিম্পিক গেমসে জয় করে নেন তিন-তিনটি স্বর্ণপদক। অর্জন করেন বিশ্বের দ্রুততম মানবীর খেতাব।

টেনেসির অত্যন্ত এক দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে অপরিণত অবস্থায় জন্ম উইলমার। জন্মের সময় তার ওজন ছিল মাত্র ২ কেজি। বাবা ছিলেন রেলের কুলি আর মা গৃহকর্মীর কাজ করতেন। ২২ ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল ২০তম। জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই ছোট্ট উইলমাকে লড়াই করতে হয় মরণব্যাধি হাম, মাম্পস, জলবসন্ত এবং নিউমোনিয়ার সঙ্গে। সে সময় কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য চিকিৎসা সেবা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল, বলতে গেলে বিরল। শুধু তার মা-ব্ল্যাঞ্চে রুডলফের অক্লান্ত সেবায় জীবন ফিরে পায় উইলমা।

পাঁচ বছর বয়সে আবার আঘাত। ভয়ংকর রোগ পোলিওতে আক্রান্ত হন উইলমা। চিকিৎসক বলে দেন, সারা জীবন পঙ্গু হয়ে কাটাতে হবে তাকে। উইলমার মা এটা মেনে নেননি। তিনি তাঁর আদরের সন্তানকে বলেছিলেন, আবার নিশ্চয়ই হাঁটতে পারবে সে। অনেক খোঁজখবর করে তাঁরা জানতে পারেন, নাভিতে অবস্থিত কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নির্মিত ফিস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল কলেজে এই রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। হাসপাতালটা ছিল তাঁদের বাসা থেকে ৫০ মাইল দূরে!

টানা দুই বছর, সপ্তাহে দুই দিন, মা তার ছোট্ট উইলমাকে নিয়ে পাড়ি দিতেন ১০০ মাইল পথ। সাত বছর বয়সে একটা ধাতব-বন্ধনীর সাহায্যে আবার হাঁটতে শুরু করে সে। মায়ের নিরলস পরিশ্রম, নিবিড় সেবা আর পরিবারের অন্য সদস্যদের ঐকান্তিক সহায়তায় ১২ বছর বয়সে কোনো কিছুর সাহায্য ব্যতিরেকে পুনরায় হাঁটার সক্ষমতা ফিরে পায় উইলমা। তারপর আর পিছু ফিরে তাকাননি এই অদম্য ক্রীড়াবিদ। যোগ দেন স্কুল বাস্কেটবল দলে। তৎকালীন বিখ্যাত অ্যাথলেটিকস কোচ এড টেম্পলের নজরে পড়েন তিনি। কোচের উৎসাহে শুরু করেন ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডসের প্রশিক্ষণ। ঘটনা এগিয়ে যায় তার নিজস্ব গতিতে।

২২ ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল ২০তম। জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই ছোট্ট উইলমাকে লড়াই করতে হয় মরণব্যাধি হাম, মাম্পস, জলবসন্ত এবং নিউমোনিয়ার সঙ্গে। সে সময় কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য চিকিৎসা সেবা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল, বলতে গেলে বিরল। শুধু তার মা-ব্ল্যাঞ্চে রুডলফের অক্লান্ত সেবায় জীবন ফিরে পায় উইলমা।

১৯৬০ সালে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, উইলমা রুডলফ নিজেকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান; জায়গা করে নেন ইতিহাসের কিংবদন্তিদের তালিকায়। তাঁর এই সাফল্যের পেছনে মায়ের অসামান্য অবদান স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘ডাক্তার বলেছিলেন আমি আর হাঁটতে পারব না; আমার মা বলেছিলেন, আমি পারব। আমি মায়ের কথা বিশ্বাস করেছিলাম।’

উপসংহারটা কী দাঁড়াল তাহলে? আসুন, প্রত্যেক শিশুকে আমরা মায়ের চোখ দিয়ে দেখি, ভালোবাসি মায়ের মতো করে। কেননা, এদের মধ্যেই আছে এডিসন, নিউটন, আইনস্টাইনের মতো পৃথিবী বদলে দেওয়া বিজ্ঞানী; আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধীর মতো রাষ্ট্রনায়ক, স্টিভি ওয়ান্ডারের মতো সংগীতশিল্পী কিংবা উইলমা রুডলফের মতো অসামান্য ক্রীড়াবিদ।

*লেখক সাজ্জাদুল হাসান, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত