মহামারিতে শিক্ষার্থীদের প্লাজমা ব্যাংক ‘টিম-৭১’

মহামারিতে শিক্ষার্থীদের প্লাজমা ব্যাংক ‘টিম-৭১’
ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবী নামক গ্রহটি বহুবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, মহামারি, বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে লড়াই করেছে। বহুবার নিমজ্জিত হয়েছে মহাপ্রলয়ে। বারবার অসুস্থ হয়েও বহু ক্ষয়ক্ষতি থেকে উতরে গিয়েছে। যার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান, তার মধ্যে তারুণ্যের অবদান সর্বাধিক। একুশ শতকে এসেও একধরনের যুদ্ধের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে এই গ্রহের সবচেয়ে উন্নত সৃষ্টি মানবজাতি। প্রাণঘাতী এক ভাইরাসের আঘাতে জর্জরিত এই পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চল। যার নাম করোনাভাইরাস।

বাংলাদেশে এ ভাইরাসে সংক্রমণ ধরা পড়ে গত বছরের মার্চে। এরপর থেকেই লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, সামাজিক দূরত্ব, সতর্কতা, চিকিৎসা কর্মকাণ্ড চলছে মহামারি প্রতিরোধে। অনেকে টিকে থাকতে পেরেছেন, অনেকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে পারেননি। অনেকে এখনো লড়াই করছেন মহামারির বিরুদ্ধে।

কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক চিকিৎসা, ইমিউনিটি সিস্টেম দিয়ে অনেকে সুস্থ হয়েছেন। সুস্থ ব্যক্তির প্লাজমাতে রয়েছে কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি, যা সুস্থ ব্যক্তির দেহ তৈরি হয়েছে। এই অ্যান্টিবডিযুক্ত প্লাজমা আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করালে খুব ভালো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে চিকিৎসকেরা এটাকেই টিকা আবিষ্কার না হওয়ার আগপর্যন্ত একধরনের কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

এ পদ্ধতির কথা জানতে পেরেই এগিয়ে এসেছে একদল তরুণ, যাঁরা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। তাঁরা স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করেন, দেখাতে ভালোবাসেন। তাঁদের নেতৃত্বে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল (ইইই) বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মো. ইসতিয়াক উদ্দিন, যাঁর দক্ষ নেতৃত্বে গত বছরের মে মাসে গড়ে উঠেছে ‘প্লাজমা ব্যাংক, বাংলাদেশ (কোভিড-১৯)’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পাশে রেখেছেন একদল প্রত্যয়ী স্বেচ্ছাসেবী, যাঁরা অনবরত কাজ করে যাচ্ছেন প্লাজমা, রক্ত সংগ্রহে, দানে, প্লাজমাদাতা-গ্রহীতার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছেন দেশের বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ কয়েকজন ডাক্তার, মেডিকেলের শিক্ষার্থী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন ফ্রন্টলাইনার যোদ্ধা, যাঁদের নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘টিম-৭১’।

দেশের ৭১ জন স্বেচ্ছাসেবক নিঃস্বার্থভাবে দিনরাত দেশব্যাপী সেবা দিয়ে যাচ্ছেন করোনায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের।
কোন চিন্তা থেকে এ পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা জানতে চাইলে মো. ইসতিয়াক উদ্দিন বলেন, ‘আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে দেখেছি, যখনই কোনো অঞ্চলে মানব–অস্তিত্বসংক্রান্ত কোনো সমস্যা আবির্ভূত হয়, তখনই প্রয়োজন হয় মানবিক সংগঠন সমন্বয়ের। আলবার্ট আইনস্টাইনের অনুগ্রহে তৈরি হয় ইন্টারন্যাশনাল রেস্কিউ কমিটি, যা মনুষ্য অস্তিত্ব সংকটে পড়লে এগিয়ে আসবে, রিকভার করবে। আমেরিকাতে তৈরি হয় ক্যাথলিক রিলিফ সার্ভিস, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে যুদ্ধাহতদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। তেমনই একটা মানবিক প্ল্যাটফর্মে আমরা “টিম-৭১” সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে প্লাজমা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। একই সঙ্গে জরুরি রক্ত সংগ্রহে কাজ করে যাচ্ছি। করোনা মহামারি শেষ না হওয়া অবধি আমাদের কার্যক্রম চলতে থাকবে।’

ইসতিয়াক নিজেও কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়েছিলেন গত বছরের এপ্রিলে। সুস্থ হয়ে নিজেও প্লাজমা দিয়েছেন। তাঁর সংগঠন এবং টিম-৭১ নামের স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ এ পর্যন্ত দুই হাজারের অধিক মানুষকে প্লাজমা, রক্ত দিয়ে, রক্ত সংগ্রহ করে দিয়ে সাহায্য করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা ব্লাড ডোনেশনের জন্যও গড়ে তুলেছে পৃথক টিম। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে ব্লাড ও প্লাজমা ডোনেশনের মাধ্যমে এই টিম দেশে মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে বলেই মনে করেন সচেতন অনেকে। ভবিষ্যতে তারা মানবিক এই কাজ আরও বাড়িয়ে দিতে চায়।