ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের গল্প

আব্বাসউদ্দীন (১৯০১-১৯৫৯) বাংলার লোকগানের এক ধ্রপদি সংগীত ব্যক্তিত্ব
অলংকরণ : মাসুক হেলাল

আব্বাসউদ্দীন (১৯০১-১৯৫৯) বাংলার লোকগানের এক ধ্রপদি সংগীত ব্যক্তিত্ব। সংগীতাঙ্গনে তথা আধুনিক কাব্যগীতি, দেশাত্মবোধক গান, ইসলামি গান, ভাওয়াইয়া সংগীত ও পল্লিগীতিতে এই শিল্পীর অবদান তুলনারহিত। বিশেষ করে লোকগানের অন্যতম ধারা ভাওয়াইয়া সংগীতকে নাগরিক মনে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে তাঁর কৃতিত্ব অসামান্য। তোরষা, ধরলা, দুধকুমার, তিস্তা, কালজানি বিধৌত উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভাওয়াইয়া সংগীতের অন্যতম অনুষঙ্গ করে মৈষাল-মাহুত-গাড়িয়ালের মাধ্যমে বিরহী নারীর আকুতি, মন-মনন, চিন্তাচেতনাকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। শিল্পী এ কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ, তাঁর এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে জন্ম ও বেড়ে ওঠা।

আব্বাসউদ্দীনের জন্ম ভারতের কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জের বলরামপুর গ্রামের এক নৈসর্গিক পল্লিতে। একদিকে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, অন্যদিকে কালজানি নদী। এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে কৃষক-শিল্পীর উদাস করা কণ্ঠে ভাওয়াইয়ার সুর দিনরাত অনুরণিত হতো। ভাওয়াইয়া যেন ছিল কর্মজীবী মানুষের প্রধান কর্মসংগীত। হালুয়া হাল বাইতে বাইতে কিংবা কৃষক খেত নিড়াতে নিড়াতে তাঁদের ভরাট কণ্ঠে ধ্বনিত হতো ভাওয়াইয়া গান—
ক’ ভাবি মোর বঁধুয়া কেমন আছে রে?
তোর বধুয়া আছে রে ভালো
দিন কতক কন্যার জ্বর গেইছে রে
ওকি কন্যা চায়া পাঠাইছে জিয়া মাগুর মাছ রে॥

আব্বাসউদ্দীনের চিন্তাচেতনায়, মন-মননে ভাওয়াইয়া গান আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষদের কণ্ঠে গীত ভাওয়াইয়া গানের সুর তাঁর পুরো সত্তাকে যেন আলোড়িত করত। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেন, ‘সেই সব গানের সুরেই আমার মনের নীড়ে বাসা বেঁধেছিল ভাওয়াইয়া গানের পাখি।’ এখান থেকেই মূলত আব্বাসউদ্দীনের ভাওয়াইয়া গানের হাতেখড়ি। তিনি কোনো সংগীতগুরুর কাছে নন; বরং গানের শিক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতির সহজ-সরল সুর-পাঠ থেকে। ভাওয়াইয়া সংগীতে ঝুঁকে পড়ার আরেকটি ঘটনা তিনি উল্লেখ করেছেন এভাবে—

‘বাড়ী থেকে দু’মাইল দূরে ঝাপই নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছি।...অকস্মাৎ বাঁশীর মতো মিষ্টি কণ্ঠ কানে এল। অমন অপূর্ব মধুময় কণ্ঠ আমার জীবনে আর শুনিনি।... স্বর ক্রমশঃ নিকটবর্তী। তারপর দেখি মহিষের পিঠে মহিষের মতো বা তার চাইতেও কালো একটি ছেলে গাইতে গাইতে মহিষটাকে পানি খাওয়াবার জন্য নদীতে নামিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে গান তার বন্ধ হয়ে গেল। কাছে গিয়ে কত অনুনয় করলামÑসিগারেট দিতে চাইলাম আর কিছুতেই তাকে রাজী করতে পারলাম না। জীবনে অমন কণ্ঠ আর শুনিনি’, (আমার শিল্পী জীবনের কথা, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ১৯৬৫)। মৈষালের এই গানই তাঁর মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। এখান থেকেই তিনি আরও বেশি ভাওয়াইয়া গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কালক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন ভাওয়াইয়ার সম্রাট। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বে ভাওয়াইয়া সংগীতকে জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হন। তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভাওয়াইয়া আজ ক্রমান্বয়ে বিকশিত হচ্ছে। লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে ভাওয়াইয়া সংগীত যত দিন টিকে থাকবে, তত দিন ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

আজ ৩০ ডিসেম্বর মহান এই প্রবাদপুরুষ সংগীতশিল্পীর ৬১তম প্রয়াণ দিবস। এই দিনে ভাওয়াইয়ামোদী, সংগীতশিল্পী, অনুরাগী, গবেষক—সবাই বিনম্র শ্রদ্ধায় মহান এই শিল্পীর অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছেন। লোকসংস্কৃতির অন্যতম আঙ্গিক লোকগানে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীন।

*লেখক: ড. মো. এরশাদুল হক, লোকসংস্কৃতি গবেষক ও প্রাবন্ধিক