বিশেষ জ্ঞানের আগে চাই সাধারণ জ্ঞান

কবি হেলাল হাফিজের কবিতা দিয়ে শুরু করা যাক। ‘নিউটন বোমা বুঝ, মানুষ বুঝ না।’ মানুষ বোঝা কিংবা মানুষ হওয়া আমাদের জন্য জরুরি। প্রায়ই দেখি, পিতা-মাতা নিজ সন্তানের জন্য অন্যদের দোয়া বা শুভাশিস কামনা করেন এই বলে যে ‘দোয়া করবেন, আমার সন্তান যেন মানুষের মতো মানুষ হয়।’ অর্থাৎ ভালো প্রফেশনাল হওয়ার চেয়েও ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা জরুরি। আমাদের শিক্ষার খুব বড় একটা জায়গা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আমরা যখন বুকে ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই, দেখা গেল ডাক্তার লিখলেন হার্টের ওষুধ, হতে পারে ব্যথাটা ছিল গ্যাস্ট্রোলিভারের। হতে পারে ডাক্তার সাহেব তা বুঝতেই চাননি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেকোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি তাঁর নিজের বিষয়টি ছাড়া অন্য বিষয় কম বুঝতে চান। অথবা সব ঘটনাকে নিজের মতো করে বুঝতে চান। হয়তো এর সঙ্গে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা অজ্ঞতা জড়িত।

একইভাবে শিক্ষার ভেতরে যত ধরনের বিশেষায়িত বিষয় রয়েছে সেগুলো বুঝতে হলে শিক্ষার ধ্রুপদি বিষয়সমূহ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হয়। নয়তো বিশেষায়িত বিষয়গুলো স্পষ্ট হয় না। মনে করুন, রাজনৈতিক বিষয়গুলোর মধ্যে কেউ যদি পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র বা মার্ক্সবাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দর্শন না বোঝে, সে অর্থনীতি বুঝবে না। আবার অর্থনীতি না বুঝলে সে সাহিত্য-ভূগোল বুঝবে না। আবার শিল্প-সাহিত্য, সৌন্দর্য, রস, মানবিকতাবোধ না বুঝলে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠা দূরের বিষয়। এ জন্য একজন রাজনীতিক, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদকে জ্ঞানকাণ্ডের আন্তশাখা সম্পর্কে সম্যক জানতে হয়, জানতে হয় ধ্রুপদি বিষয়-আশয়। এ জন্যই গবেষণা করতে গেলে প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি ভালোভাবে পর্যালোচনা করে নিতে হয়।

বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের ওপরে বিশেষভাবে জোর দিতে হবে। জ্ঞানের মূলভিত্তি সম্পর্কে যদি জানাশোনা কম হয় তবে ব্যক্তি জ্ঞান আহরণের পূর্ণ স্বাদ পাবেন না। বরং ধীরে ধীরে জ্ঞান অর্জনে আগ্রহ কমতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থার এই যে সাধারণ স্তরগুলো শিক্ষাকে মহিমান্বিত করে তুলেছে, সেই জায়গাগুলো থেকে দিন দিন অনেক দূরে সরে গিয়েছি আমরা। ফলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি বাড়লেও প্রকৃত মানুষ হওয়ার পথ দিনে দিনে সরু হয়ে আসছে। মনুষ্যত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রত্যেক মানুষের অধিকার ও কর্তব্য রয়েছে, প্রতিটি বিষয়ে তার নিজের মতো করে ভেবে দেখার। তার নিজের একান্ত দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে অবলোকন করার। নিজের মতো করে চিন্তা করার। অথচ যদি এমন হয় যে, আমি যদি বুঝতেই না পারি, আমার সামনে শিল্প-সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি বা সাংবাদিকতার মতো বিষয় আলোচিত হলো, এত এত ব্যাখ্যা এল। অথচ এগুলো যদি আমরা বুঝতে না পারি তবে সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার পথে বাধা রয়েই যাবে। নিজের ভাবনা ছাড়া অন্য বিষয় গ্রহণ করতে না পারার অক্ষমতাও আমাদের পিছিয়ে দেয়। অথচ জানা দরকার যে দর্শন নানাভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে। যে কারণে অর্থনীতি, সমাজনীতি, নৃবিজ্ঞান, ভূগোল ও সাহিত্যসম্পর্কিত বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে। একটি বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা জানতে পারলেই, আমরা ভাবতে পারব যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে আমি যেভাবে ভাবছিÑসেটি আদতে অন্যভাবেও ভাবা যায়। তখনই কেবল ভাবনার শাখা-প্রশাখাগুলো বিকশিত হয়। একের প্রতি অপরের শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি পায়। সমাজের মানুষের মধ্যে হিংসা লোপ পায়, বিকশিত হয় অহিংসার নীতি।

এখানে অর্থশাস্ত্রের দৃষ্টি ফেলার অবকাশ রয়েছে। এই যে ভুল জায়গায় বিনিয়োগ হচ্ছে, সেখানে ব্যাষ্টিক (মাইক্রো) দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায়, ব্যক্তি ‘একক’ হিসেবে হয়তো মুনাফা করছে, এগিয়ে যাচ্ছে। আবার একই ঘটনাকে যদি সামষ্টিক (ম্যাক্রো) দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তবে দেখব, এই মুনাফা শুধু কমে যাচ্ছে না বরং আরও ক্ষতির কারণ হচ্ছে। বিশেষত শিক্ষার ক্ষেত্রে এ কথা জোরেশোরে প্রযোজ্য। শিক্ষার রস আস্বাদন করার যে তাগিদ, সেই তাগিদবোধ দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে সমন্বয়হীনতা বড় হয়ে দেখা দেয়। আর এই সমন্বয়হীনতা সম্ভবত আমাদের জাতীয় অসুখের বড় কারণ। আমরা যদি প্রতিবেশী দেশ ভুটানের কথা বলি, সুখী মানুষের দেশসমূহের যে বৈশ্বিক সূচক রয়েছে, সেখানে তাদের অবস্থান ঊর্ধ্বমুখী। অন্তরের সুখ বা সুখে থাকাকে তারা জীবনে সফলতার বড় একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) [তাদের মূল দৃষ্টি জিএনএইচ তথা মোট জাতীয় সুখ] তাদের এই সুখের মূল্য অনেক। এমনকি তাদের রয়েছে সুখসম্পর্কিত একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ও।

ঢাকাই চলচ্চিত্রের বিখ্যাত শিল্পী কবরী চলে গেলেন। তিনি তাঁর এক সাক্ষাৎকারে নিজের নিঃসঙ্গতার কথা বলেছেন। সবকিছু থাকতেও তিনি যে আদতে বন্ধুহীন ছিলেন, সেই অভাবের কথা তিনি বলে গেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানও একা বাসায় লোকান্তরিত হলেন। কাউকে পাশে পেলেন না। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করা এক বিত্তশালীর সুইসাইড নোট বলছে, তিনি কতটা নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলেন। কোভিড নয় একাকিত্ব তাঁকে নিয়ে গেল দূরে কোথাও, অন্য এক গন্তব্যে। এই মানুষেরা প্রত্যেকেই বিত্তশালী-সচ্ছল এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। অথচ তারা একা। প্রায় দুই কোটি মানুষের এই মহা শহর ঘাঁটলে এমন নিঃসঙ্গ মানুষের মিছিল কত বড়, তা অনুমান করা সহজ হবে। এ রকম পরিস্থিতিতে আমাদের শিক্ষার অর্থ, শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। শিক্ষার প্রকৃত অর্থ বুঝতে বা বোঝাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি বলে প্রতীয়মান হয়।

আমাদের জীবনে এখন শিক্ষার অতি সাধারণ জ্ঞানের সমাবেশ ও সম্মিলন ঘটছে না। আমরা এখন প্রত্যেকে ট্রেনের এক একটি স্বতন্ত্র বগির মতো হয়ে গেছি। যেন একটির সঙ্গে আরেকটির যোগাযোগ নেই, আলাপ-পরিচয় নেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের তুমুল অহংবোধ আমাদের একাকিত্বকে আরও বিষিয়ে তুলছে। জীবনের সুখটুকু খুঁজে নেওয়ার জন্য যে দর্শন প্রয়োজন, সেই দর্শন আমাদের তালাশ করতে হবে।Ñতা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও হতে পারে, হতে পারে চায়ের দোকান থেকেও। এই যে বিখ্যাত মানুষগুলো আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, তাঁদের আমরা চিনতাম। কিন্তু তাঁদের কোনো দিন অনুভব করিনি। আমাদের শিক্ষা হয়তো এই বোধ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

জাতীয় জীবনের নানা মারপ্যাঁচে পড়ে আমাদের সামষ্টিক সুখের তালিকা দিনে দিনে সংকুচিত হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা আজকাল পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি না বুঝে পুস্তক বুঝতে চাই বা বোঝাতে চাই। অথচ এটাই বাস্তবতা যে সাধারণ জ্ঞান, বোধ-বুদ্ধির বিকাশ না ঘটিয়ে বিশেষায়িত জ্ঞানদানের আয়োজন সফল হতে পারে না।

লেখক: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক