ফিরে দেখা ২০২০ সাল: প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি
সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আজ শেষ প্রান্তে এসে হৃদয়ের স্পন্দনে একটি প্রশ্ন তাড়িত হলো, আসলে আমরা বছরটিকে (২০২০) কীভাবে বলব ‘দুই হাজার বিশ সাল’, নাকি ‘দুই হাজার বিষ’? বাংলার ভাগ্যাকাশে এই বছরের শুরুতে উড়েছিল জয়ের নিশান, অর্থাৎ ৯ ফেব্রুয়ারি—আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল করেছিল শিরোপা জয়, যা ছিল বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম বিশ্বকাপ জয়। ভেবেছিলাম এমন জয় ২০২০-এ বাংলার মাটিতে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকবে, বাংলার নীল আকাশে কখনো ঘনীভূত হবে না কালো মেঘ, বইবে না দূষিত বায়ু, হবে না কারও স্বপ্নের মরণ। ভেবেছিলাম বছরের শুরুতে এমন জয় যেন বিজয় মাসের উল্লাসের আগমনী বার্তা। কিন্তু না, ২০২০-এর মার্চ মাসেই বাংলার আকাশে ঘনীভূত হয়েছিল কালো মেঘ, বয়েছিল অস্থিরতা নামের দূষিত বায়ু। যে কারণে ১৭ কোটি মানুষকে হাবুডুবু খেতে হয়েছিল, হচ্ছে আতঙ্কের মহাসাগরে। মানে আমি বলতে চাচ্ছি ৮ মার্চ তারিখটির কথা। যেদিন আমার সোনার বাংলায় প্রথম তিনজনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। আর এই শনাক্তের হার যখন ৩ থেকে ৩৯-এ দাঁড়িয়েছিল, তখনই ঘরবন্দী হতে শুরু করেছিল গোটা বাঙালি জাতি, মানে ২৬ মার্চ যেদিন বাংলাদেশে প্রথম লকডাউন শুরু হয়েছিল। ফলে এই লকডাউন আস্তে আস্তে নিয়ে আসছিল মৃত্যুর ডাক, স্বপ্নের মরণের কুবার্তা। মানে আমরা দেখি ১৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু হয়। শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, ২০২০-এর ২০ মে দক্ষিণাঞ্চলে হানা দিয়ে আম্পান নামের ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়, যার ফলে প্রাণনাশ ঘটেছিল ১৬টি স্বপ্নবোনা পাখির, অর্থাৎ চতুর্দিকে কেবলই স্বপ্নের মরণ আর বাতাসে লাশের গন্ধ।
আজও এই বাতাসে এমন লাশের গন্ধ দূরীভূত হয়নি, আবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রকৃতিতে ঠাঁই করে নিচ্ছে অহরহ। তবু কি ২০২০ আশীর্বাদপুষ্ট! আজ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিমজ্জমান। চতুর্দিক থেকে ভেসে আসছে কেবল অস্থিরতার গ্লানি, বিষণ্নতা, অভাব-অনটন, দুর্নীতি, রেষারেষি, কলহ, বিচ্ছেদ, ধর্ষণ, আত্মহত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধ। আজ কারও মনে শান্তি নেই, শান্তি যেন নসিরামবাবুর ভান্ডারঘরে ধরা খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। তবু কি ২০২০ আশীর্বাদপুষ্ট! বন্যা আমাদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করেছে, ধর্ষণ আমাদের লাঞ্ছিত করেছে আর আত্মহত্যা আমাদের দিয়েছে হৃদয় ভাঙা বিষাদের ঢেউ। এসব কিছু ২০২০-এই পাওয়া। তবু কি আমরা বেঁচে আছি? হ্যাঁ, না মরে বেঁচে আছি কেবলই সৃষ্টিকর্তার কৃপায়।
ইতিহাসের কল্যাণে জানতে পারলাম, বিগত কয়েকটি শতক জনমানবের জন্য ছিল অভিশপ্ত। কোনো শতকে ছিল দুর্যোগ, কোনো শতকে ছিল ভাইরাসের উত্থানে সৃষ্ট মহামারি। হয়তো ২০২০-ও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। চলুন ২০২০ সালের কয়েকটি বিষয় আলোচনা করি, তাহলেই আমরা বলতে সক্ষম হব যে ২০২০ সাল আসলে আমাদের জন্য কেমন ছিল?
১. করোনা মহামারি
মহামারি মানেই সর্বগ্রাসী। পৃথিবীতে যত মহামারি এসেছে, তা কেবল শোকের বার্তারই প্রমাণ করে। তাই ২০২০-এর করোনা মহামারি হিতে বিপরীত হবে না, এটাই স্বাভাবিক। এই মহামারি কত কিছু যে তছনছ করে দিয়েছে তা বলা বাহুল্য; বাবার কাঁধে দিয়েছে ছেলের লাশ, মাকে পরিয়েছে সাদা শাড়ি, বোনকে করেছে বিধবা, ভাইকে করেছে ভ্রাতৃহারা। আবার প্রকৃতিকে ডুবিয়েছে আতঙ্কের বন্যায়, মানুষকে করেছে ঘরবন্দী, অর্থনীতিকে করেছে পঙ্গু, সামাজিকতায় দিয়েছে বিষণ্নতা, কলহ, আত্মহত্যা, ধর্ষণ; রাজনীতিতে এনেছে দুর্নীতি। আর কী লাগে! তবু এই মহামারি থামছে না, চলছে আপন সত্তায় নতুন রূপে, নতুন গতিতে। তাহলে এবার চলুন জেনে আসি এই করোনা মহামারিসৃষ্ট কিছু ঘটনা।
দুর্নীতি
দেশ সৃষ্টির লগ্ন থেকে বাংলাদেশ ছিল দুর্নীতিতে ভরপুর। এখনো আছে, তবে তা যেন রূপে, নতুন পথে। আমরা যা-ই বলি না কেন, দুর্নীতি বাংলাদেশে প্রধান সমস্যা। যে কারণে আমরা দেখি বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম স্থানটাই পেয়েছিল বহুবার। তবু বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল, যাচ্ছে কিন্তু সে এগিয়ে যাওয়া! এক গ্লাস দুধে এক ফোঁটা বিষ দিলে যেমন, সারা বাংলা সমৃদ্ধ হলেও দুর্নীতি যেন সেই এক ফোঁটা বিষ, অর্থাৎ তেমন। করোনাকালে এই দুর্নীতি যেন বাংলাদেশে মারাত্মক হারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ২০১৯ সাল থেকে ২০২০ সালে দুর্নীতি বেড়েছে বহুগুণে। এই ২০২০, আমাদের সাহেদ-সাবরিনা-মালেককে চিনিয়েছে, চিনিয়েছে করোনাকালে সাহায্য প্রদানে সহস্র চাল চোর, দেখিয়েছে সাহায্যের নামে ছবি তোলা, অতঃপর সাহায্য কেড়ে নেওয়ার হিড়িক। আজ যেখানেই চোখ রাখি, যেন দেখতে পাই দুর্নীতি, দুর্নীতি; সে হোক স্বাস্থ্য খাত, সেবা খাত, শিক্ষা খাত, এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্য। সুতরাং এই নতুন রূপে দুর্নীতি যেন ২০২০ সালেরই ফলাফল। আর তা এখনই উৎখাত করা আমাদের সময়ের দাবি।
ধর্ষণ
কথায় আছে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।’ করোনাকালে ঘরবন্দী জীবনে অনেকে দর্শক, হয়ে উঠছে ধর্ষক। তাদের থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছোট শিশু, বৃদ্ধ কিংবা রাস্তার পাগলিও। ইতিহাস বলে, আগের তুলনায় এ বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মতে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৯৩ জন নারী ও শিশু, যাদের মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ২০৫ জন এবং ধর্ষণসহ অন্যান্য যৌন হয়রানির শিকার ২ হাজার ৭১১ জন নারী ও শিশু।
আত্মহত্যা
আত্মহত্যা একটি জঘন্যতম অপরাধ। তবু মানুষ করে হয়তো ব্যর্থতায় কিংবা হতাশায়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২০ সালে বাংলাদেশে, এমনকি সারা বিশ্বে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে বেশ। লকডাউনের ফলে নানান অভাব-অনটন কিংবা হতাশা, দুর্দশা এমনভাবেই চেপে ধরেছে, যার জন্য হয়তো একটি মানুষ মহাপাপটিই করে বসেছে। আর এ পর্যন্ত কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই মেধাবী ১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছেন, তাহলে সারা বাংলাদেশে এই সংখ্যা কত হবে, তা আজ ভাববার বিষয়।
কিছু প্রাপ্তির বদলে অপ্রাপ্তি
২০২০ সালের ২৬ মার্চে স্বাধীনতার উল্লাস, ১ মে শ্রমিকের স্বার্থ আদায়ের মহাযাত্রা, ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিনের আনন্দ, ১৫ আগস্ট শোকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের উল্লাস ও মুজিব বর্ষ উদ্যাপন—এসব ২০২০-এ আমাদের পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পাইনি।
২. বন্যা
সরকারি হিসাবমতে, বাংলাদেশে ২০২০ সালে ৩১টি জেলা প্লাবিত হয়েছিল, যার ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের শিকার হয়েছে অর্ধকোটি মানুষ।
৩. ঘূর্ণিঝড়
২০২০ সালে ২০ মে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছিলে আম্পান নামের এক ঘূর্ণিঝড়। ফলে সরকারি হিসাবমতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ২৫ জেলার প্রায় দেড় কোটি মানুষ, যাদের মধ্যে ১৬ জন প্রাণ হারিয়েছিল এবং অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্তের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
এসব বিষয় স্পষ্ট করে দেয় যে আমরা ২০২০ সালকে কীভাবে বলব ‘দুই হাজার বিশ’, নাকি ‘দুই হাজার বিষ’। তবে বিষে ভরা ২০২০ সাল হলেও সে বিষের অন্তরালে ছিল কিছুটা অমৃত, যা হয়তো তালের সংস্পর্শে তিলের ন্যায় অদৃশ্যমান কিন্তু সত্যি বলতে, সেগুলো বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে পুনরাবৃত্তি করে, বিশ্বের দরবারে দেখিয়ে দেয় ’৭১-এর অকুতোভয় বাঙালি আজও মরেনি, বেঁচে আছে কর্মে আর স্পৃহায়। বলছিলাম...
১.
বিজয়ের মাসে অসম্ভবকে সম্ভব করার দৃষ্টান্তস্বরূপ পদ্মা জয়: ১০ ডিসেম্বর ১২তম ও ১৩তম পিলারে সর্বশেষ তথা ৪১তম স্প্যানটি বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু দৃশ্যমান করার মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে বাঙালি জাতি, তথা বাংলাদেশ সরকার।
২.
কিশোর সাদাতের নোবেল জয়: ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের নড়াইলের ১৭ বছর বয়সী সাদাত রহমান, সাইবার বুলিং ও সাইবার ক্রাইম নিরোধে ‘সাইবার টিন’ অ্যাপসটি আবিষ্কার করে ছোটদের জন্য বিশ্ব নোবেল জয় করে। আর এই পুরস্কার গ্রহণ করে মালালা ইউসুফজাইয়ের হাত থেকে, যা বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের গৌরবের বিষয়।
৩.
বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পদার্পণ।
৪.
জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ: সম্প্রতি (২০২০ সাল) ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তার প্রতিবেদনে প্রকাশ করছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভারত থেকে তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে ওপরে আছে বাংলাদেশ, যা বাঙালি জাতির জন্য সুখের ও গর্বের। তা ছাড়া বর্তমানে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ অনুসারে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আর তারা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, যদি এভাবে জিডিপির হার বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাহলে আগামী ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের বৃহৎ ২৫তম অর্থনীতির দেশ, যা আজকের দিনে তথা ২০২০ সালে আমাদের লাল-সবুজের দেশ, বাংলাদেশের জন্য সুখের-সানন্দের আগমনী বার্তা।
সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে ২০২০ সাল ভোলার নয়, এই বছর ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। এ প্রজন্ম তো নয়ই, পরবর্তী প্রজন্মও এই বছরকে খুঁজে পাবে মহামারির ইতিহাসে। তবে শুধু বাঙালি জাতিই নয়, গোটা বিশ্বই মনে রাখবে, ২০২০ তুমি কেমন ছিলে। যা-ই হোক, বিষে ভরা বিশ চলে যাক, ‘২১ আসুক গানে গানে, কবিতার ছন্দে ছন্দে মঙ্গলবার্তা বয়ে। বাংলার, বাঙালি জাতির স্বপ্ন জয় হোক, জয় হোক চিরসবুজের, জয় হোক মানবতার। আবার সূর্য উঠে কিরণ ছড়াক, চন্দ্র ঢালুক জোছনা, বাগানে ফুটুক ফুল, প্রকৃতিতে বয়ে বেড়াক সুবাতাস, সমুদ্র পাক জীবন্ত সত্তা।
*লেখক: জসীম উদ্দিন, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়