প্রকৃত দেশপ্রেম মানে কী

ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রত্যেক মানুষ জন্ম নেয় পৃথিবীর একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে, যা তার কাছে তার স্বদেশ। অর্থাৎ, একটি শিশু যে দেশে জন্মগ্রহণ করে, সেটাই তার স্বদেশ। এই স্বদেশের সঙ্গেই গড়ে ওঠে তার গভীর সম্পর্ক। স্বদেশের জন্য তার মনে জন্ম নেয় এক নিবিড় ভালোবাসা। স্বদেশের আলো, বাতাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্যের সঙ্গে গড়ে ওঠে তার শিকড়ের বন্ধন। স্বদেশের প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি গভীর এই অনুরাগ ও বন্ধনের নামই স্বদেশপ্রেম। মা, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি মানুষের যে চিরায়ত গভীর ভালোবাসা, তারই বিশেষ আবেগময় প্রকাশ ঘটে স্বদেশপ্রেমের মধ্যে।

ওপরের বাক্যগুলো কেবলই স্বদেশপ্রেমের সংজ্ঞা। কিন্তু বাস্তবে প্রকৃত অর্থে দেশপ্রেমের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। কেননা, দেশপ্রেমকে কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। আরিফ আর হোসাইন দেশপ্রেম সম্পর্কে একটি কথা বলেছিলেন, ‘আমিসহ ৫০ জনকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় দেশপ্রেম কী, তাহলে ৫১ জনই ভিন্ন উত্তর দেবে। কেননা, আমি নিজেই দুবার দুই রকমের উত্তর দেব। বাকি ৫০ জন ৫০ রকমভাবে দেশপ্রেমকে সংজ্ঞায়িত করবে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটা দেশপ্রেম না। জীবনের ৪০টি বছর পর এসে জানতে পারলাম, দেশপ্রেম মানে হচ্ছে ডেডিকেশন।’

১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার একটা লিস্ট তৈরি করেছিল। বুদ্ধিজীবীরা দেশের স্বাধীনতা অর্জন, দিকনির্দেশনা ও বহির্বিশ্বে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন। কারণ, তাঁরা তাঁদের কাজে ডেডিকেটেড ছিলেন। আর এ জন্যই পাকিস্তানিরা সেক্টর ধরে ধরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল।

দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস করতে চাও, জহির রায়হানকে মারো। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করতে চাও, মুনীর চৌধুরীকে মারো। দেশের সংস্কৃতি ধ্বংস করতে চাও, আলতাফ মাহমুদকে মারো। অর্থাৎ, দেশের জন্য যে যেই কাজে ডেডিকেটেড, তাঁকে মেরে ফেলো। পাকিস্তানিরা কিন্তু তা–ই করেছে।

২০১৬ সালের শেষ দিকে ভারতের বিখ্যাত তবলাবাদককে পেছনে ফেলে বাংলাদেশি যুবক প্রথম হয়েছেন। আচ্ছা, তিনি যদি তবলা বাজানোর পাশাপাশি গিটার বাজাতেন, কিংবা গান গাওয়া শুরু করতেন, তাহলে কিন্তু তিনিও হয়তো বিশ্ববিখ্যাত তবলাবাদক হয়ে উঠতে পারতেন না।

আবার আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যার যদি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চালানোর পাশাপাশি মুভি বানানো শুরু করে দিতেন, তাহলে কিন্তু তিনিও হয়তো আজ বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠতে পারতেন না। অন্যদিকে বিশ্বসেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান যদি ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি অন্যান্য খেলাধুলায় মনোনিবেশ করতেন, তাহলে তিনিও কিন্তু আজকের এই বিশ্ববিখ্যাত ক্রিকেটার হতে পারতেন না। তাঁরা পেরেছেন। কারণ, তাঁরা তাঁদের কাজে ডেডিকেটেড ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। আর এটাই দেশপ্রেম।
একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন, আপনি কোনটাতে সেরা। কোনটাতে সাপোর্ট পাচ্ছেন।

তারপর চোখ খুলে সেই কাজে নেমে পড়ুন। আপনি ভালো লিখতে পারেন, তাহলে লেখাটাই ভালোভাবে চালিয়ে যান না দেশের কাজে। আপনি ভালো ছবি আঁকতে পারেন, তাহলে সেটাতেই ডেডিকেটেড থাকুন না। সেটা দিয়েই আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও দেশের কথা তুলে আনেন না।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ

আপনি ভালো ছবি তুলতে পারেন, ভালোভাবে মোটিভেট দিতে পারেন, ভালো গান লিখতে পারেন, ভালোভাবে গান গাইতে পারেন, ভালো নাচতে পারেন ইত্যাদি যেটাই ভালো পারেন, সেটাতেই ভালোভাবে লেগে থাকুন, ডেডিকেটেড থাকুন। আপনার এই লেগে থাকা, এটাই কিন্তু দেশপ্রেম।

আরেকটু ক্লিয়ার করে বলি। আচ্ছা, একজন ক্রিকেটারের দেশপ্রেম কী? দেশের হয়ে খেলা, ছক্কা মারা, ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাচ ধরা। হ্যাঁ, এটাই দেশপ্রেম। কারণ, তাঁরা এটাতেই ডেডিকেটেড। এটা দিয়ে তাঁরা দেশের সুনাম বয়ে আনবেন। এটা দিয়েই দেশকে রিপ্রেজেন্ট করবেন।

আচ্ছা, একজন ক্রিকেটারের কি ইচ্ছা করে না পেট ভরে কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে। মন চায়। তারপরও খান না। কারণ, বেশি খেলে ফিট থাকা যাবে না। তাঁদের কি মন চায় না বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিতে, আড্ডার মধ্যে যা তা খেতে, যা ইচ্ছা তা করতে। মন ঠিকই চায়। কিন্তু করেন না। ওই যে, তাঁরা ক্রিকেটে ডেডিকেটেড। তাঁরা বাজে কিছুতে আশক্ত হলে ক্রিকেটে ভালো কিছু দিতে পারবেন না। তাই তাঁরা এসবে যান না, দেশকে ভালো কিছু দেওয়ার জন্য। আর এটাই দেশপ্রেম। সব কাজের কাজি হওয়ার নাম দেশপ্রেম না।

সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না, হবেও না। আপনি শুধু যেটাতে ভালো পারেন, ভালো বোঝেন, সেটাতেই নিঃস্বার্থভাবে লেগে থাকুন। আর এর জন্যই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে ডাক দিয়েছিলেন ঠিক এইভাবে, ‘যার যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো শত্রুর মোকাবিলার জন্যে।’

আপনি টগবগে যুবক, সুস্থ–সবল; আপনি তাড়াতাড়ি বন্দুক হাতে নেমে পড়ুন স্বাধীনতাযুদ্ধে।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
ছবি: আবদুস সালাম

আপনার কণ্ঠ সুন্দর। ভালোভাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। আপনি যান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে দেশের অবস্থান সম্পর্কে খবরাখবর ও গতিবিধি সম্পর্কে সচেতনতামূলক বার্তা প্রেরণ করুন সবার মধ্যে।

আপনি নারী। ভাবছেন কীভাবে যুদ্ধে যাবেন। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনি তাড়াতাড়ি একদল মুক্তিবাহিনীকে আজ রাতে রান্না করে খাওয়ান। এটাই তো মুক্তিযুদ্ধে আপনার সবচেয়ে বড় অবদান।

আপনি বৃদ্ধ। ভাবছেন, কীভাবে যুদ্ধে যাবেন। আপনি নৌকা চালাতে পারেন। তাহলে আপনারও চিন্তার কোনো কারণ নেই। আজ রাতে মুক্তিবাহিনীরা পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাবেন। আপনি তাঁদের নৌকা চালিয়ে নদী পার করে দিন। এটাই আপনার দেশের পক্ষে স্বাধীনতাযুদ্ধের সবচেয়ে বড় অবদান।
ওপরের সবাই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা।

বঙ্গবন্ধু কিন্তু ভেবেচিন্তেই বলেছিলেন, ‘যার যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো।’ এই যার যা কিছু আছে তা–ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়াই হলো দেশপ্রেম। এটাই হলো হারিয়ে ফেলা সেই একাত্তরের চেতনা।

আসুন আমরা যে যেটাতে বেস্ট, সেটাতেই ডেডিকেটেড থাকি, সেটাই মনোযোগ দিয়ে করি। দেশ আমাদের কী দিচ্ছে, সেটা না ভেবে দেশকে আমরা কী দিচ্ছি, সেটা ভাবায় হচ্ছে দেশপ্রেম। দেশকে মন থেকে ভালোবাসুন, একটা সময় দেখবেন, দেশ আপনাকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে।


*লেখক: শিক্ষার্থী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ।