পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে যা করতে হবে  

পেঁয়াজ
ফাইল ছবি

গত বছর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে হঠাৎ ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয় আর তখনই দেশে পেঁয়াজের বাজার প্রতি কেজি ২৫০/৩০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কম হওয়ার আমাদের পেঁয়াজের চাহিদা পূরণে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। আর স্বাদ, চাহিদা, পরিবহন ব্যয় স্বল্পতাসহ বিভিন্ন কারণে বেশির ভাগ আমদানি করা পেঁয়াজের বেশির ভাগই আসে ভারত থেকে। গত বছর ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের পর মিশর, তুরস্ক, মিয়ানমার, পাকিস্তান থেকে আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়।

গত বছরের মতো এবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ইতিমধ্যে পেঁয়াজের বাজারে শুরু হয়ে গেছে অস্থিরতা, প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৩০/৪০ টাকা বেড়ে গেছে! পরিস্থিতি সঠিকভাবে সামাল দিতে না পারলে এ বছরও হয়তো পেঁয়াজের দাম বেড়ে যেতে পারে।

পেঁয়াজের বাজারের অস্থিরতার স্থায়ী সমাধান কোথায়? সরকারি হিসাবে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৩০ লাখ মেট্রিকটন। দেশে প্রতি বছর উৎপাদিত হয়, ২৩ লাখ মেট্রিকটন। কিন্তু অব্যবস্থাপনা এবং সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাবে ৪-৫ লাখ টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। ঘাটতির এই পেঁয়াজের সিংহভাগই ভারত থেকে আমদানি করতে হয়।

ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে

প্রথমত, দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের ৪-৫ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। সেগুলো যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য হওয়ায় এগুলোর সংরক্ষণের অভাবেই বিশাল একটা অংশ নষ্ট হয়ে যায়। আলু সংরক্ষণের জন্য যেভাবে হিমাগার আছে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্যও পর্যাপ্ত হিমাগারের ব্যবস্থা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, নষ্ট হওয়ার হাত থেকে পেঁয়াজ রক্ষা করতে পারলেও, দেশে আরও অতিরিক্ত ৭-৮ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ উৎপাদনের প্রয়োজন পড়বে। বর্তমানে যতটুকু জমিতে পেঁয়াজ চাষ করা হয়, কৃষকদের উন্নতমানের বীজ প্রদান, সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমেই এই অতিরিক্ত উৎপাদনের অনেকটা পূরণ করা সম্ভব। এর বাইরে কৃষকদের পেঁয়াজ উৎপাদনে প্রণোদনা এবং ন্যায্য দাম নিশ্চিতের মাধ্যমে চাষ বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

তৃতীয়ত, যে কোনো কৃষি পণ্য উৎপাদন নির্ভর করে বাজার দরের ওপর। দুঃখজনক হলেও সত্য পেঁয়াজের মৌসুমে প্রান্তিক কৃষকেরা পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হন। তাই এমনিতেই তুলনামূলকভাবে দাম অনেক কম থাকে। তা সত্ত্বেও একই সময়ে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি হয়। ফলে দাম আরও কমে যায়। ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় কৃষক। পেঁয়াজ উৎপাদনের কৃষকদের উৎসাহিত করতে সবার আগে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। আর এটি করতে হলে অবশ্যই মৌসুমে পেঁয়াজের আমদানির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করতে হবে।

চতুর্থত, দেশে যদি মোট চাহিদার অর্থাৎ ৩০ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ উৎপাদন সম্ভব হয় তাহলে আমদানির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করতে হবে। ফলে দেশের মানুষ যেমন সহনীয় দামে পেঁয়াজ পাবে, কৃষকেরাও সঠিক দাম পাবে।

পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতা কমাতে একটা অনুপ্রেরণা হতে পারে গরু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। ২০১৪ সালে ভারতে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন পরেই গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ঐতিহাসিকভাবেই ভারত থেকে এ দেশে গরু রপ্তানি হয়ে আসছিল। এমনকি দেশের কোরবানির গরুর বিশাল একটা অংশ আসত ভারত থেকে। হঠাৎ গরু আমদানি বন্ধ হওয়ায় দেশে মাংসের দাম লাফিয়ে ৫৫০-৬০০ টাকা হয়ে যায়। কিন্তু বছর দুইয়ের মধ্যেই দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়। দেশে অসংখ্য গরুর খামার প্রতিষ্ঠিত হয়, অসংখ্য যুবকের কর্মসংস্থান হয়। এখন আমরা গরু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া মানেই দেশের মজুতকৃত সব পেঁয়াজ শেষ হয়ে যাওয়া না। ঠিক এই মুহূর্তে দাম বাড়ার প্রধান কারণ অসাধু ব্যবসায়ীদের কালো বাজারি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও অনেক বেশি তৎপর হতে হবে। দ্রুততম সময়ে বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। স্থায়ীভাবে পেঁয়াজ উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: মো. শহীদুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়