টিকটক: আমাদের টনক নড়বে কবে

টিকটক
ছবি : রয়টার্স

জুনের দুই তারিখ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রচারিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘একাই হাজারের বেশি নারীকে ভারতে পাচার করেছেন মেহেদি’। জুনের তিন তারিখে আরেকটি খবরের শিরোনাম, ‘ভারতে পাচার হওয়া কিশোরীর মামলায় গ্রেপ্তার তিনজনকে রিমান্ডে চাইছে পুলিশ’।

বেশ কয়েক দিন ধরে সমাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়া টিকটক জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। তবে এ জোয়ার ভালো জোয়ার নয়। এ জোয়ার মন্দ জোয়ার। কয়েক দিন আগে টিকটকের ফাঁদে পড়ে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার হয়ে যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার এক তরুণী ৭৭ দিন পর দেশে ফিরে আসেন। তারপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাঁর দেওয়া তথ্য চমকে দেয় সবাইকে। এরপর বিভিন্ন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর সব ঘটনা। যার কারণে চলমান এ জোয়ারের ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে সবখানে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও নির্যাতনের শিকার তরুণীর বয়ানে উঠে এসেছে লোমহর্ষক ঘটনা।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের ঝাং ইয়েমিংয়ের হাত ধরে সামাজিক বিনোদনমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া টিকটক অ্যাপ্লিকেশনটির আক্ষরিক অর্থ হলো, গলা কম্পন ছোট ভিডিও। চীনে ডুইয়িন নামে পরিচিত এ অ্যাপ্লিকেশন চীনের নীতিনির্ধারকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ না ফেললেও, ঠিকই দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের ফেলে দিয়েছে মহাদুশ্চিন্তায়। টিকটক আর লাইকির মতো অ্যাপসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ছোট–বড় অসংখ্য অপরাধী চক্র। এই অপরাধী চক্রগুলোর নেটওয়ার্ক আবার দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ডালপালা মেলে বসেছে। আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী দলের সঙ্গে সখ্য তৈরি করে সক্রিয় হওয়া এসব চক্রের বেশির ভাগ টার্গেট উঠতি বয়সী মেয়েরা। শরৎচন্দ্র কিংবা রবীন্দ্রনাথের মতো লেখকদের বই ছেড়ে টিকটকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এসব উঠতি বয়সী তরুণীকে টিকটকের সস্তা মডেল বানানোর লোভের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের নিয়ে রাজধানী ঢাকার অদূরে বিভিন্ন হোটেলে প্রতি সপ্তাহ কিংবা মাসে ওই সব চক্র আয়োজন করত পুল পার্টির। আর ওসব পুল পার্টি থেকে তাদের টার্গেট তরুণী কিংবা কিশোরীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা হতো। তারপর টিকটক ভিডিও বানানোর নাম করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সীমান্ত এলাকায় নিয়ে গিয়ে তাদের কৌশলে তুলে দেওয়া হতো ওপারে ছদ্মবেশে থাকা আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী দলের সদস্যদের হাতে।

র‌্যাবের তথ্যমতে, এসব চক্র নারী ও তরুণীদের প্রথমে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের সঙ্গে সখ্য তৈরি করে তাঁদের উচ্ছৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত করাত। তারপর উন্নত জীবনযাপনের লোভ দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যৌনকর্মী হিসেবে পাচার করে দিত। ভালো বেতন আর উন্নত জীবনযাপনের সুখের স্বপ্নে মত্ত এসব তরুণী অপরাধী চক্রের হাতে যাওয়ার পর বুঝতে পারত, আসলে তাঁরা পাচারের শিকার, তখন অনেকেরই কিছু করার থাকত না। অসহায় হয়ে একসময় উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখা এসব তরুণী হয়ে উঠেন বিভিন্ন হোটেলের নিয়মিত নাইট গার্ল। কোভিডের কারণে এখন দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ। অনলাইন ক্লাস কিংবা অনলাইনে পড়শোনার এ ফাঁকে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন গেমের অ্যাপস কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে অবাধে বিচরণ করতে থাকে। আর এই সুযোগকে অপরাধী চক্ররা তাদের ফাঁদ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন পার্ক কিংবা উদ্যান এখন উচ্ছৃঙ্খল টিকটক গ্রুপের আনাগোনায় মুখরিত থাকে নিয়মিত। এসব উচ্ছৃঙ্খল গ্রুপের প্রায় সবাই উঠতি বয়সী কিশোর–কিশোরী কিংবা তরুণ–তরুণী। তাঁদের বেপরোয়া আচার-আচরণের কারণে অনেকে এখন পার্ক কিংবা উদ্যানে হাঁটতে যেতেও ভয় পান। এখন আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক কিংবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রামের সুমতি’ গল্পের রামের মতো সহজ-সরল অথচ দুরন্ত বালক দেখা যায় না।

ডিজিটালায়নের এ যুগে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সহজলভ্যতা ও অভিভাবকদের অসচেতনতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারময় এক স্থানে। যেখানে তৈরি হচ্ছে হিতাহিত বোধহীন এক মানবসমাজ। এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আশাবাদী আলোর চেরাগের এই নিবু নিবু অবস্থার জন্য যতটা না এই প্রজন্ম দায়ী, ঠিক তার চেয়ে বেশি দায়ী আমাদের অভিভাবকেরা। টিকটক আর লাইকির এই যুগে ডিজিটাল স্মার্টনেসের দৌড় লাগাতে গিয়ে অনেকে ছিটকে পড়ছেন আসল মনুষ্যত্বের রাস্তা থেকে। আবার কখনো এই মাধ্যমগুলোকে অপরাধের হাতিয়ার বানিয়ে অনেকে হয়ে উঠছেন আন্ডারগ্রাউন্ডের মাফিয়া। অবৈধভাবে আয় করছেন কোটি কোটি টাকা।

আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মহাকালের গহ্বর থেকে টেনে তুলে সমকালের উন্মোচন ঘটিয়ে আশাবাদী একটি আলোকোজ্জ্বল প্রজন্ম তৈরি করতে চায়, তাহলে এখনই সময় টিকটক আর লাইকির মতো অ্যাপসের লাগাম টেনে ধরার। কারণ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপরই আমাদের আগামীর সম্ভাবনার বাংলাদেশ নিহিত। যাঁদের হাত ধরে দুর্বার গতিতে আসবে অপার সমৃদ্ধি, তাঁদের আসন্ন ভয়াবহতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি মাত্র। আর তা না হলে এর পরিণামে আমাদের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। আশাকরি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।


লেখক: হিমু চন্দ্র শীল, শিক্ষার্থী, কক্সবাজার সরকারি কলেজ।