ক্রিকেট হোক অর্থনৈতিক উন্নতির হাতিয়ার

বিশ্বজয়ী যুবাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশের ক্রিকেট
ছবি: আইসিসি

বাংলাদেশ ক্রিকেটে সফলতার ধারা অব্যাহত না থাকা নিয়ে আমাদের আক্ষেপের শেষ নেই। যে দল ২০১০ সালেই নিউজিল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলকে ঘরের মাঠে হোয়াইটওয়াশ করতে পারে, সেই দল কেন ২০২১ সালে এসেও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেবে। যে দল ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে এবং ২০০৭ উইন্ডিজের মাটিতে ভারত ও সাউথ আফ্রিকার মতো তৎকালীন শক্তিশালী দলকে হারাতে পারে, সে দল কেন ২০২১ সালে এসেও বিদেশের মাটিতে কাঙ্ক্ষিত সফলতা পায় না, তা নিয়ে হতাশা থাকছেই।

ধারাবাহিক সফলতা না পাওয়াকে একপাশে রাখলে বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। কেননা, যে বাংলাদেশ ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের সুপার এইটে খেলেছিল, সেই বাংলাদেশ ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়েছিল। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল এবং ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে সেমিফাইনাল খেলেছিল। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে উইন্ডিজ ও সাউথ আফ্রিকাকে হারানোসহ আফগানিস্তানকে হারিয়েছিল। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জয় না পেলেও ২ উইকেটে পরাজয়ের আগে কিউই ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও হার মানার আগে লড়াই করেছিল দুর্দান্তভাবে। এর আগে একাধিকবার এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলাও স্পষ্টতই উন্নতির পক্ষে কথা বলে।

প্রত্যাশামতো বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সের উন্নতি না ঘটলেও সাকিবের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হওয়া এবং নিয়মিতই পারফর্ম করা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সেরা অর্জন। সাকিবের অর্জন কিংবা মাশরাফির হার না মানা লড়াই বিশ্ব ক্রিকেটে সমাদৃত। দেশীয় সমর্থকদের বাঁধভাঙা উল্লাস ছাড়াও বহির্বিশ্বের ক্রিকেট–সংশ্লিষ্ট সবার খুব ভালোভাবেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের ওপর নজর আছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশিদের উন্মাদনা এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের সময়ে সময়ে অবস্থানের ওপর ভিত্তি করেই ক্রিকেট বোর্ড ও ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত রোজগার বাড়ছে। আয়–রোজগারের মূলে দেশীয় স্পনসর ছাড়াও আইসিসি থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও ক্রিকেটাররা ভিনদেশি লিগ খেলে রোজগার অন্যতম।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে সফলতাপ্রাপ্তির ধারাবাহিকতাহীনতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই স্পনসর ও সমর্থকদের আগ্রহ নিয়ে। এ দুটি জায়গায় দিন দিন আগ্রহ-উন্মাদনা বাড়ছেই। ক্রিকেট নিয়ে চরম উন্মাদনা ও ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে বলেই তরুণ-তরুণীরা ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ক্রিকেটে পা রাখছেন। জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নপূরণ বহুদূর হলেও স্বীকৃত ক্রিকেটে খেলতে পারলে একজন ক্রিকেটার সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে বেশ ভালোভাবেই অর্থ উপার্জন করতে পারেন। যদিও বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান ও ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। কিন্তু এটি আমার এ লেখার বিষয়বস্তু নয় বলে এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করছি।

৯ এপ্রিল, ১৯৯৭। বিশ্বকাপের স্বপ্ন পূরণ। উল্লাসে মেতেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটার ও ক্রিকেট কর্মকর্তারা। সেই মুহূর্তটিকে ক্যামেরায় ধরে রেখেছিলেন প্রথম আলোর বিশেষ আলোকচিত্রী শামসুল হক।

একসময় ক্রিকেটারদের আয়ের মাধ্যম ছিল জাতীয় দল, ঘরোয়া ক্রিকেট ও ব্যক্তিগত স্পনসর। সেই তালিকায় এক যুগের অধিক হলো যুক্ত হয়েছে ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক টি–টোয়েন্টি লিগ। ২০০৮ সালে আইপিএলের মাধ্যমে টি–টোয়েন্টি লিগের নতুন জোয়ার শুরু হওয়ার ধারাবাহাকিতায় এখন ক্রিকেট খেলুড়ে প্রায় দেশগুলোই টি–টোয়েন্টি লিগ আয়োজন করছে। ১০০ বলের ক্রিকেটও আয়োজন হচ্ছে শিগগিরই, যার মাধ্যমে ক্রিকেটারদের আয়–রোজগারের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি ক্রিকেটার ভিনদেশি লিগে সুযোগ না পেলেও সময়ে সময়ে আব্দুর রাজ্জাক, আশরাফুল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম, মুশফিক, রিয়াদ, মুস্তাফিজসহ অনেক ক্রিকেটার ভিনদেশি লিগে খেলেছেন। আর সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান তো টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা হয়েই খেলছেন সর্বত্র সফলতার সঙ্গে। হালের টি–টেন লিগেও সম্প্রতি খেলে এসেছেন একাধিক ক্রিকেটার।

বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটার ছাড়া পুরোনো সব দলগুলোর ক্রিকেটার, এমনকি হালের জনপ্রিয় আফগানিস্তানের বহু ক্রিকেটার টি-টোয়েন্টি লিগে খেলছে সফলতার সঙ্গে। উইন্ডিজ, আফগানিস্তান, ইংল্যান্ডসহ বহু দেশের ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে খেলার আগেই দেশি-বিদেশি লিগগুলোতে খেলে পরিপক্ব হচ্ছেন। লিগ খেলে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন সেসব ক্রিকেটাররা। সেই সঙ্গে বড় বড় ক্রিকেটারের সঙ্গে খেলার সুবাদে খেলায় উন্নতিসাধনের মাধ্যমে দেশের হয়ে পারফর্ম করছেন দারুণভাবে। ঠিক এই জায়গাতেই পিছিয়ে বাংলাদেশ। অথচ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চাইলেই দেশীয় ক্রিকেটারদের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আগ্রহী করে তোলার জন্য নিয়মিত একাধিক টি-টোয়েন্টি লিগ আয়োজন করা এবং টি-টোয়েন্টি বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য তাঁদের পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা দিয়ে গড়ে তোলার মাধ্যমে ভিনদেশি লিগে খেলার উপযোগী করে তুলতে পারেন। অর্থ উপার্জন ছাড়াও পারফম্যান্সের উন্নতির মাধ্যমে দেশের ক্রিকেটে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারবেন সেসব ক্রিকেটাররা।

যেহেতু বাংলাদেশ ক্রিকেটের মূল্য আছে বিশ্ব ক্রিকেটে। দেশের তরুণ-তরুণীরাও ঝুঁকছেন ক্রিকেটে এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আয়োজিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। ক্রিকেটারদেরও মাথায় রাখতে হবে যে পেশাদার ক্রিকেটে জাতীয় দলই শেষ কথা নয়। নিজেকে এমনভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে যে স্বীকৃত ক্রিকেটে যেখানেই সুযোগ হবে এবং সুযোগ আসবে, সেখানেই যেন খেলতে পারেন। বিশেষ করে বিদেশি টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতে খেলার জন্য টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সামর্থ্য আছে, এমন ক্রিকেটারদের নিজেদের খেলার উন্নতির জন্য সর্বদা চেষ্টা করতে হবে। জাতীয় দলই শেষ কথা নয় এবং জাতীয় দল ছাড়াও বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ আছে এখন, এমন মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে ক্রিকেটাররা যেন ভিনদেশি লিগে খেলার মতো নিজেদের গড়ে তুলতে পারেন এবং ভিনদেশি লিগে খেলার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন ও খেলার উন্নতির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও ক্রিকেটে অবদান রাখতে পারেন, সেই ব্যবস্থা বিসিবিসহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরই করতে হবে।

*লেখক: শিক্ষার্থী