কোনো এক মায়ার টানে  

লেখকের মা

মা, মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় আমি আর তুমি যেন এক হয়ে যাচ্ছি। তোমার অস্তিত্ব আমি অনুভব করি। তুমি যখন ছিলে মা, কখনো এমন করে উপলব্ধি করিনি। করলে কী ভালোই না হতো!!!

আমাদের সঙ্গের মানুষটি যখন আমাদের সঙ্গে থাকেন, তখন আমরা এত বেশি অভ্যস্ত হয়ে যাই যে তাঁদের অস্তিত্বকে চিরস্থায়ী মনে করি। অথবা অস্তিত্ব টেরই পাই না। অভ্যস্ততার ব্যাপারটি বুঝতে পারি। কিন্তু এটা কেমন কথা যে এখন আমার প্রায়ই মনে হয় যে আমি আর তুমি এক হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আসলে তো আমরা এক নই। তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিত্ববান আর আত্মমর্যাদাশীল ছিলে। আমি আর তুমি কখনোই এক নই, যদিও তোমার গর্ভে আমার জন্ম।

তুমি তোমার ৮০তম জন্মদিনে চলে গেছ। এই পুরোটা সময় কখনো নিজের অসুস্থতা নিয়ে, নিজের পার্থিব কোনো চাহিদা নিয়ে কারও মুখাপেক্ষী হওনি। নিজের দেখভাল, নিজের সংসার আর নিজের এক বিরাট সামাজিক নেটওয়ার্ক—সবকিছু নিজেই চালিয়ে গেছ। যদি না চালাতে, ভালো হতো মা। আমরা তোমার চাহিদা বুঝতে পারতাম। কিন্তু তুমি তো তা করবে না। কারণ, তুমি আজকের অনেকের চেয়েই অনেক বেশি মর্যাদা নিয়ে চলতে।

এই যে তোমার আত্মমর্যাদা, এই যে তোমার সংস্কৃতি—এটা একটা সময়ের কথা বলে মা। তোমার জন্ম চল্লিশের দশকের শেষে একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার ঘরে। জেগে ওঠা মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের ঐতিহ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি তোমার মধ্যে গেঁথে ছিল। আমার মতো তরল না তুমি। অনেক বেশি স্থির—ধরিত্রীর মতো চলমান, কিন্তু বোঝা যায় না। তোমার কাছে গল্প ছিল নারায়ণগঞ্জ মরগ্যান গার্লস স্কুলের, রাজশাহী পিএন গার্লস স্কুলের, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আজিমপুর গার্লস স্কুলে আর রেলওয়ে পাবলিক স্কুলে অল্প কিছুদিন চাকরি করেছিলে, তার গল্পও ছিল। অসাধারণ ছিল তোমার গল্প করার ক্ষমতা—৫ থেকে ৮০, সবাই শুনত মুগ্ধ হয়ে। অনেকেই তোমার গল্প বলার ক্ষমতার প্রশংসা করে আজও। কিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো লাগে এটা ভাবতে, তুমি তোমার মতোই ছিলে আজীবন নিজের মূল্যবোধগুলো নিয়ে।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমরা এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে প্রায় মাস দুয়েক ঘুরে বেড়িয়েছিলাম এক বস্ত্রে। তেমনি কোনো একদিন একটি ষাঁড় আমাকে তাড়া করেছিল। তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিলে। গত বছর কোরোনাকালে তুমি যখন চলে গেলে, আমি কি পেরেছিলাম সবকিছু ঠেলে ফেলে তোমার সামনে দাঁড়াতে?
মা, গত এক বছরে তোমার মতো আরও অনেকের চলে যাওয়া আমাকে একটা সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের আগের প্রজন্মের দেখভাল করার জন্য আমরা তৈরিও না, সচেতনও না। একজন শিশুর যত্ন নেওয়া, তা-ও হয়তো কিছুটা অন্তর্ভুক্ত আমাদের সামাজিক বাতাবরণে, বয়স্কদের জন্য কতটুকু প্রস্তুত আমরা? অথচ জীবনের মায়া তো সবার জীবনেরই থাকে। জীবনকে চালিয়ে নিতে সব জীবিতই চায়। এই চাওয়ার পাশে একটুখানি ভরসা দিতে আমরা যে কতখানি অপ্রস্তুত, গত এক বছর আমাদের তা বুঝিয়ে দিয়েছে।

আমার মায়ের নাম মায়া। আমার মাসহ যত প্রবীণ গত এক বছরে চলে গেছেন, তাঁদের মায়ার টানে এই লেখার মাধ্যমে আমার ক্ষুদ্র শ্রদ্ধার্ঘ্য।

লেখকের মা

মা মায়ার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

১৯৪০ সালে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলায় জন্ম। বাবা জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সেলিমা বেগম। এসএসসি পাস করেন রাজশাহী পিএন গার্লস স্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে। উচ্চমাধ্যমিক এবং গ্র্যাজুয়েশন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন বাংলা সাহিত্যে। তিনি ১৯৬২-৬৩ সালে বছর দেড়েক আজিমপুর গার্লস স্কুলে চাকরি করেন এবং ১৯৭৬-১৯৮০ চট্টগ্রামের রেলওয়ে পাবলিক স্কুলে চাকরি করেন। তাঁর বিয়ে হয় প্রকৌশলী আমানুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে, যিনি পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ভাশুর এবং নাজমা জেসমিন চৌধুরী তাঁর জা ও স্কুলজীবনের বান্ধবী।
*লেখক: সামিনা চৌধুরী, উত্তরা, ঢাকা।