ওগো তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে

ফাইল ছবি: প্রথম আলো।

আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।

বসে আছি। টিনের চালওয়ালা বারান্দায়। গল্পের বই হাতে। গুনগুনিয়ে আবৃত্তি করছি—ওপরে লিখে রাখা পঙক্তি দুটি। রিমঝিম বৃষ্টি ঝরছে। যেন বৃষ্টি নয়, টিনের চালে নৃত্যরত অচেনা এক নৃত্যপরা। খানিক আগেই আকাশটা ছিল মেঘে মাখানো। সারি বেঁধে উড়ছিল সজল-কাজল মেঘ। প্রকৃতিজুড়ে লেপ্টে ছিল গুমোট আঁধার। দৃষ্টির শেষ অব্দি ছিল মেঘেদের রাজত্ব। এখন তেমনটা নেই! প্রকৃতির গুমোট অভিমান ভাঙাতে আকাশের বুক চিরে বৃষ্টি হয়ে নেমেছে মেঘ। আকাশ গলগল করে প্রত্যাখ্যান করছে মেঘমালাকে। বৃষ্টি ঝরছে। অঝোর ধারায়। রাবেকার চোখের জল হয়ে। টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে পুকুরজলে‚ খাল–বিলে, টিনের চালে। বৃষ্টি নামছে আর জন্ম দিচ্ছে এক পাগল করা ছন্দ। ছন্দমধুর। দিনমান শ্রবণেও মন্দ লাগে না। আসে না বিরক্তির ছিটেফোঁটাও।

মেঘের গুরু গুরু গর্জন। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে খানিক পরপর। গর্জন আর বিদ্যুৎ চমকানোতে কেঁপে উঠছে কদমের ডালে বসে থাকা টুনটুনিটি। হয়তো কেঁপে উঠছে ঘরদোরে থাকা ছেলে-বুড়ো সবাই। কদমগাছটা আমাদের ঘরের কোণেই। ওখান থেকে বাতাসে ভেসে আসছে কদমের মনমাতানো ঘ্রাণ। টানা বৃষ্টির নূপুর-নিক্বণ আর দিল কাড়া গন্ধে আমি হারিয়ে যাই অন্য জগতে। ডুব দিই প্রকৃতিপ্রেমে! বর্ষার এত্ত আয়োজনের ভেতর গল্পের বইটা যেন অচেনা একজনা; যার সঙ্গে ভাব জমানো মুশকিল!

এমন মুগ্ধতায় ডুবিয়ে রাখার কারণেই হয়তো বর্ষাকে তুলনা করা হয় প্রেমময়ী নারীর সঙ্গে।

জনমানবহীন পথঘাট। এটাই মানায় বেশ বর্ষার সঙ্গে। মানানসই দৃশ্যটাকে উপেক্ষা করে চোখে বাজল এক মানবের ছবি। আলতো পায়ে হাঁটছেন, পিঁপড়ার মতো!

আসছেন গোরস্তানের ওদিক থেকে। বলে রাখি, আমাদের বাড়িটা রাস্তার পাশেই, তাই এসব দৃশ্য চোখে ভাসে অনায়াসে। ভাঙা ছাতায় মুখ–বুক ঢাকা পথচারীর। তাই প্রথমে চিনতে পারিনি! পরক্ষণেই দমকা হাওয়া এলে ভাঙা ছাতাটা উল্টে যাওয়ার উপক্রম! বাতাসের অছিলায় দেখা হলো পথচারীর কুচকুচে কালো মুখাবয়ব।

তবে! না দেখাটাই ভালো ছিল! কষ্ট হতো না। দুঃখরা দানা বাঁধত না ভেতরে! ব্যথা হতো না বুকের মাঝখানটায়! পথচারী লোকটি ময়না দাদা।

নদীতে নয়া জোয়ার আসার পরদিনের কথা!

সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টিধারার সঙ্গে সঙ্গে বিজলি চমকাচ্ছিল। আকাশটাও গর্জন করছিল থেকে থেকে। সব মিলিয়ে ভীতিকর একটা দিন। তবু জীবিকা নির্বাহের তাগিদে স্টিমার নিয়ে বেরিয়েছিলেন ওনার বড় ছেলে। নিয়তির খেলা! স্টিমার নিয়ে চেলা নদীতে পৌঁছামাত্রই একখণ্ড বাজ পড়ল ছেলেটির ওপর। জ্বলে গেল পুরো শরীর। স্টিমারের ওপর থেকে টুপ করে জলে লুকোল তাঁর দেহখানা। টানা তিন দিন খোঁজার পর হদিস মিলল লাশের। কবরস্থ করা হলো চতুর্থ দিন। এ জন্যই হয়তো কবিগুরু সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন—

‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’

হয়তো ছেলের কবরটা দেখতেই বৃষ্টি ভেদ করে বেরিয়েছিলেন ময়না দাদা। বৃষ্টিমেদুর, মোহ লাগানো এ বর্ষা সবার তরে সুখের নয়! আবার দুঃখেরও নয় সবার তরে!

দুপুর গড়াচ্ছে। বৃষ্টি থামার কোনো আলামতই নেই ! কখনো ঝমঝমাঝম ‚ কখনো মুষলধারা‚ কখনো ছিঁচকাঁদুনে টিপটিপ বৃষ্টি। ঝরছে তো ঝরছেই। হয়তো কোনো বালিকা হিজল ফুলের মালা গেঁথে গেঁথে কাটাচ্ছে এ মিষ্টি দুপুর। জানালার পাশে বসেছি। নিমগ্ন চোখে উপভোগ করছি বৃষ্টিমুখর দিন। ভ্যানগাড়ির টুংটাং হর্ন কানে বাজল। তাকালাম, গাঁয়ের এক ভ্যানচালক ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাসনকোসন, সঙ্গে আরও মালামাল। ভ্যানের পেছন পেছন হেঁটে চলেছেন জমির চাচা। মনে পড়ল। গত রাতে খাবার খেতে খেতে বাবা বলছিলেন, ‘জমির মিয়ার ভিটেটাও চলে গেছে নদীগর্ভে। ওটাই ছিল তাঁর বাপ–দাদার রেখে যাওয়া একমাত্র সম্পদ। মাথা গোঁজার সম্বল।’ ভিটেমাটি হারিয়ে চাচা এখন ‘অধিক শোকে কাতর’প্রায়! কে যেন আমাকে শুনিয়ে যায়—
‘নদীর কূলে বাস‚ দুঃখ বারো মাস ’। অন্য ঋতুকে ধাক্কা মেরে বর্ষায় প্রবাদটি বলীয়ান হয়ে ওঠে।

এ জন্যই হয়তো বর্ষাকে বলা হয় আনন্দ–বেদনার ঋতু।
বলা হয়, বিরহের কাল।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আবার আয়োজন করে বসেছি জানালার কপাট খুলে দিয়ে। পৃথিবী নীরব হয়ে যাচ্ছে আঁধারকে সঙ্গী বানিয়ে। একমনে শুনছি বৃষ্টির ছন্দ। এমন ছন্দ কানে বাজলে উচাটন মন চায় মেঘে মিশে হারিয়ে যেতে। ছন্দের সঙ্গে ছন্দ গেঁথে দিতে দিলে আসন গেড়ে বসে যান কবিগুরু—
আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল‚
গেল রে দিন বয়ে।
বাঁধন–হারা বৃষ্টিধারা
ঝরছে রয়ে রয়ে।
একলা বসে ঘরের কোণে
কী ভাবি যে আপন–মনে
সজল হাওয়া যূথীর বনে
কী কথা যায় কয়ে।

খারাপ না তো! পরিবেশ আর মনপ্রাণের সঙ্গে বড্ড মিলন ঘটেছে চরণগুলোর। নীরবতাকে তাড়িয়ে দেয় ছোট বোনটি এসে। ‘ভাইয়া, চা’টা খেয়ে নে‚ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু,’ এটুকু বলেই বিদায় হয় সে। হয়তো কাজ এগোচ্ছে মায়ের সঙ্গে। এমন সন্ধ্যায় চা হলে বেশ জমে। তাই চায়ের সঙ্গে মিলন ঘটেছে প্রকৃতি আর পরিবেশের।

কয়েক চুমুকেই চা’টা শেষ করে নিই। ডুব দিই বইয়ের পাতায়। পরীক্ষা অতি নিকটে। পরীক্ষার পড়াশোনা এগোতে হবে। যদিও মন বসছে না তেমন! রাত কিছুটা গভীর হতেই বই বন্ধ করে দুটো ভাত খেয়ে নিলাম। আয়োজন করলাম ঘুমের। এমন রাতের ঘুম‚ বড্ড আয়েশের...

আমি ঘুমিয়ে পড়ি। হয়তো এ বর্ষারাতে জেগে থাকে কেউ। কারও স্মরণে চুপিসারে আবৃত্তি করে—

‘অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে।
নিদ্রা নাহি তোমায় চাহি’ আমার নয়ন-পাতে।
ভেজা মাটির গন্ধ সনে
তোমার স্মৃতি আনে মনে,
বাদলী হাওয়া লুটিয়ে কাঁদে আঁধার আঙিনাতে...।
লেখক: মুহাম্মাদ আবদুল কাদির, কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট।