আমরা কি এ অবস্থান ধরে রাখতে পারব?

মাস্ক সঙ্গে রাখতে হবে
ছবি: প্রথম আলো

করোনার অতিমারি সামগ্রিক জীবনব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। তছনছ করে দিয়েছে স্বাভাবিক জীবনধারা। সব সেক্টরে অবর্ণনীয় ক্ষতি করেছে বিধ্বংসী এই করোনা। করোনা ২০২০ সালকে পুরো বিষে পরিণত করেছে। বিশ্ব ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করেছে এই করোনা।

দেশে করোনা সংক্রমণের পর থেকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক খাতের অপব্যবস্থাপনা, অক্ষমতা, দুর্নীতি আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল অবস্থা আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। করোনা না এলে হয়তো দেখা যেত না দেশের স্বাস্থ্য খাতের এমন দুর্বলতা, অপব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির হালচাল তথা স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক করুণ চিত্র।

সাবরিনা-শাহেদদের ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট–বাণিজ্য, করোনা সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা, চিকিৎসার অবহেলায় রোগীর মৃত্যু, ড্রাইভার মালেকের দুর্নীতি, করোনার প্রণোদনায় লুটতরাজ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড রীতিমতো জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে আসছিল। এত খারাপ সংবাদের ভেতরে আমাদের জন্য একটু সুসংবাদ রয়েছে।

সম্প্রতি বিদেশি এক গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদ দেশের মানুষের মনে কিছুটা হলেও শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। সংবাদটিতে বলা হয়, ‘মহামারি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।’ এমন স্বস্তিদায়ক তথ্য উঠে এসেছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের ‘কোভিড রেজিলিয়েন্স র‌্যাঙ্কিং’-এ। তবে এ র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় সক্ষমতাসহ বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে কয়েক মাস ধরে কোভিড সহনশীল দেশের আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে ব্লুমবার্গ। গত নভেম্বর মাসে ২৪তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ নৈপুণ্য দক্ষতা দেখিয়ে এক মাসের ব্যবধানে চার ধাপ ওপরে উঠে এসেছে, যার বর্তমান অবস্থান ২০তম।

ব্লুমবার্গের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে কোভিড পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত ৩৪ জন। মাসে মৃত্যুহার ১ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতি ১০ লাখে মারা গেছে ৪৪ জন। ব্লুমবার্গের মতে, জীবনযাত্রার মান নির্ণায়ক সূচকগুলোর মধ্যে জিডিপি আর যোগাযোগব্যবস্থার গতির দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে জনজীবনে লকডাউনের প্রভাব আর স্বাস্থ্যসেবার মানের দিক থেকে।

পিছিয়ে থাকা অবস্থানের দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে চোখের সামনে বর্তমানের বাস্তবচিত্রটাই ভেসে ওঠে। আর সেই বাস্তব চিত্রই বাংলাদেশের করোনা প্রতিরোধকে বেশ কিছুটা পেছনের দিকে টেনে রেখেছে। করোনা প্রতিরোধ প্রশ্নে জনসচেতনতায় প্রচার কম হয়নি। এতে সরকারের প্রচেষ্টাকেও ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষের বোধোদয় ঘটেনি, তারা স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে সচেতন হয়নি। উল্টো তাদের স্বাস্থ্যবিধিকে তোয়াক্কা না করে স্বাধীনভাবে চলাচল করতে দেখা যায়। বৈশ্বিক এই ক্রান্তিকালে দেশের জনসাধারণ এমন আচরণ করতে থাকলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। আমাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

এটা সর্বজনবিদিত, ভাইরাস প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে মাস্কের ব্যবহার। আর এই মাস্ক করোনাভাইরাসের ৮০ শতাংশ প্রতিহত করতে সক্ষম। এসব জেনেবুঝেও দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো মাস্ক ব্যবহার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে মানুষ মাস্ক ব্যবহারে সতর্ক থাকলেও এখন আর আগের মতো দেখা যায় না। হাঁট-বাজার, রাস্তাঘাট, শপিং মল, ব্যস্ততম জায়গাগুলোর দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অতি দ্রুতই এর একটা ইতিবাচক পরিবর্তন দরকার এবং নিজ থেকেই এই পরিবর্তন আনতে হবে। বন্দুকের নল ঠেকিয়ে এ কাজে পূর্ণাঙ্গ সফলতা সম্ভব নয়। দেখা যায় কয়েক দিন মাস্ক পরিধান নিয়ে অভিযান চালালে, জরিমানা করলে ভয়ে–আতঙ্কে কিছুটা সচেতনতা বাড়ে। কিন্তু এরপর আবার একই অবস্থা ‘যে লাউ সে কদু’। একটা সরকার, প্রশাসন আর কতটুকুই–বা করবে! মানুষ যদি নিজ থেকে সচেতন না হয়, তাহলে কোনোভাবেই এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।

এখন আমাদের ইচ্ছা আর বিবেকের তাড়নার ওপরই নির্ভর করছে আমরা উন্নতির দিকে যাব, নাকি ধ্বংসের দিকে যাব। আর একই সঙ্গে বর্তমানে সরকারকেও ব্যাপক প্রচারণাসহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, করোনার জনসচেতনতায় আগের তুলনায় সরকারের প্রচার যেন একটু শিথিল হয়ে এসেছে।

বর্তমান এই পরিস্থিতিতে এটাকে আরও শক্তিশালী ও বেগবান করা দরকার।

করোনার এই মহামারি ঠেকাতে, দেশকে নিরাপদ রাখতে আমাদের প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে, আর সরকারও শতভাগ সহযোগিতাসহ এগিয়ে আসবে। এটুকুই আমাদের চাওয়া। শোনা যাচ্ছে ভ্যাকসিন আসছে। তবে এখনো আসেনি। আশা করা যায়, ২০২১ সালে ভ্যাকসিন আমাদের হাতে আসবে। যত দিন এই ভ্যাকসিন-বিবর্জিত থাকব, তত দিন এই সচেতনতা ও সতর্কতা ছাড়া আমাদের কাছে প্রতিরোধের জন্য আর কোনো হাতিয়ার নেই। তাই মাস্ক ব্যবহার, স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং সচেতনতা দিয়েই মহামারি করোনাকে প্রতিহত করতে হবে।

করোনা প্রতিরোধে সরকারের বর্তমান একটা সিদ্ধান্ত প্রশংসার দাবি রাখে। সেটি হলো ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস নীতি’। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা পেতে হলে নাগরিককে মাস্ক পরিধান করে আসতে হবে, তা না হলে সেবা দেওয়া হবে না। করোনা প্রতিরোধে এটা একটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এ রকম সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানেও এমন কড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। গণপরিবহন, দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁও ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নীতি চালু করতে হবে। যেমন মাস্ক ছাড়া গণপরিবহনে চলাচল করতে না দেওয়া, মাস্ক ছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁয় প্রবেশের অনুমতি না দেওয়া, মাস্ক ছাড়া পণ্য বেচাকেনা না করা। যদি এ নীতি না মানে, তার জন্য শাস্তির বিধান রাখা। এভাবে সব ক্ষেত্রে যখন মাস্ক পরিধানের বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে, মানুষ তখন এমনিতেই মাস্ক পরতে বাধ্য হবে। এ বাধ্যবাধকতা একসময় অভ্যাসে পরিণত হতে বাধ্য। আর এভাবে সব নাগরিক ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে সচেতন হলে দেশে ‘মাস্কবিপ্লব’ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে, যা করোনা–পরবর্তী সময়েও আমাদের স্বাস্থ্যসচেতন হতে সাহায্য করবে।

লেখক: ইমরান ইমন, শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]