অন্য রকম বিচার

‘ভাইজান, একটু দাঁড়ান।’
পেছন থেকে দুটো লোক সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়াল। এর মধ্যে একজন ডবল এক্সএল সাইজের মোটা। আর অপরজনের ফিগার জিরো সাইজের। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, কিন্তু এই লোক দুটোকে এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ল না।

‘আপনারা কি আমাকে ডাকছেন?’ প্রশ্ন করলাম।
‘জি আপনারে ডাকছি।’ জিরো সাইজের লোকটি উত্তর দিল।
‘আমি কি আপনাদের চিনি?’

‘তা তো জানি না। তবে আমাদের আপনার চেনা উচিত। আমার নাম শাহজাহান। আর ওর নাম মোটা বাবুল।’

‘জি না, আমি শাহজাহান এবং মোটা বাবুল নামে কাউকে চিনি না। তবে আমি একজন শাহজাহানের কথা জানি, যার স্ত্রীর নাম ছিল মমতাজ। তিনি প্রচুর পয়সা খরচ করে তাজমহল বানিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, আমি ওই ভদ্রলোককে কখনো দেখিনি। ভাই, আপনি কি সেই শাহজাহান?’

‘ভাইজান কি আমার লগে মশকরা করতেছেন?’

‘মশকরা করব কেন? আমি আপনাকে চেনার চেষ্টা করছি।’
‘না, আপনার মন চাইলে মশকরা করতে পারেন। কারণ, আমি তো আর আপনের শ্বশুর না।’

‘তাহলে আপনি আমার কী হন?’
‘আমাদের সঙ্গে চলেন, তাহলেই বুঝবেন আমরা আপনের কী হই।’
‘আমি আপনাদের সঙ্গে যাব কেন?’
‘যাবেন। কারণ, ভাই আপনারে ডাকতাছেন।’
‘কে আপনার ভাই? উনি কোথায়?’

‘যে দোকান থেকে একটু আগে কলা-বিস্কুট কিনে খাইছেন, তার পাশের দোকানের সামনে ভাই বসা আছেন।’

‘বুঝলাম। কিন্তু আমাকে কেন ডাকছেন?’
‘আগে চলেন, গেলেই জানবেন কেন আপনারে ডাকতাছে।’
‘সরি, আমি তো এখন যেতে পারব না। আমার কাজ আছে।’
‘যাবি না মানে! তুই তো যাবি, তোর সঙ্গে তোর দাদাশ্বশুরও যাবে।’
‘মাই গড! আপনি দেখি তুই-তোকারি করছেন।’

‘কেন, তুই কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে তোরে তুই কওয়া যাবে না? চুপচাপ চল, না হলে চাপাতি দিয়ে একদম ভুঁড়ি নামায়ে দেব।’
‘ভুঁড়ি নামায়ে দেবেন মানে কী!’

‘ভুঁড়ি নামায়ে দেব মানে ভুঁড়ি নামায়ে দেব। তুই ভুঁড়ি চিনিস না? ভুঁড়ি মানে স্টমাক।’
শাহজাহান আঙুল দিয়ে আমার পেটে খোঁচা মেরে ভুঁড়ির অবস্থান কোথায়, তা দেখিয়ে দিল।

‘জি ভাই, আমি ভুঁড়ি চিনতে পারছি। ভুঁড়ি নামাতে হবে না, আমি যাচ্ছি।’
আর কোনো কথা না বাড়িয়ে শাহজাহান আর মোটা বাবুলের সঙ্গে পা বাড়ালাম। কারণ, স্টমাকের মায়া সবারই আছে।

চায়ের দোকানের সামনে যেতেই ভাইকে দেখলাম। ভাই একটি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। চোখে সানগ্লাস। টেবিলের ওপর এক প্যাকেট সিগারেট রাখা। যদিও তিনি এই মুহূর্তে সিগারেট খাচ্ছেন না। তার হাতে একটা রুবিক্স কিউব। অনবরত সেটা তিনি মেলানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভাব দেখে মনে হচ্ছে না যে এই জীবনে তার পক্ষে এটা মেলানো সম্ভব। বড় ভাইয়ের সামনে দাঁড়াতেই শাহজাহান বলে উঠলেন, ‘ভাইরে সালাম দেন।’

‘আসসালামু আলাইকুম।’ আমি সালাম দিলাম।

‘কী নাম আপনার?’ সালামের উত্তর না দিয়ে রুবিক্স কিউব ঘোরাতে ঘোরাতে প্রশ্ন করেন বড় ভাই।

‘আমার নাম রানা। ভাই, আপনি তো আমার সালামের উত্তর দিলেন না।’

আমার কথা শেষ হওয়ামাত্র বড় ভাই রুবিক্স কিউব মেলানো বন্ধ করলেন। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে সরাসরি আমার দিকে তাকালেন। আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘না ভাই, এমনি বলেছি। সালামের উত্তর লাগবে না। তা বড় ভাই, আপনি আমাকে এখানে ধরে এনেছেন কেন?’

বড় ভাই কোনো উত্তর দিলেন না। উত্তর দিলেন শাহজাহান।

‘তুই কি ভাইরে প্রশ্ন করলি? তোর এত বড় সাহস। চাপাতি দিয়ে একদম ভুঁড়ি নামায়ে দেব।’ শাহজাহান কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল।

শাহজাহান ফিসফিস করে বললেও বড় ভাই ঠিকই শুনতে পেলেন। তিনি শান্ত গলায় বললেন, ‘শাহজাহান, তোমার এই এক সমস্যা। শুধু ভুঁড়ি নামানোর অছিলা খোঁজো। ভুঁড়ি নামানো কোনো কাজের কথা না। যাও, তুমি রানা সাহেবের জন্য একটু চা-নাশতার আয়োজন করো।’
‘জি ভাই।’

বলেই শাহজাহান চায়ের দোকানের ভেতর চলে গেলেন। একটু পরই শাহজাহানের সঙ্গে দোকানের এক কর্মচারী ট্রেতে করে চা-নাশতা নিয়ে এলেন। শাহজাহান ট্রে থেকে এক কাপ চা ও একটি শিঙাড়া ভাইয়ের সামনে রাখলেন। আর এক কাপ চা ও পিরিচে করে একটি কলার খোসা আমার সামনে রাখলেন।

‘নিন রানা সাহেব, চা-নাশতা খান।’ ভাই মিষ্টি করে বললেন।
‘আমি চা খাই না।’
‘ঠিক আছে, চা খেতে হবে না। নাশতাটা খান।’
‘নাশতা! কোথায় নাশতা?’
‘ওই যে, পিরিচে।’ শাহজাহান পিরিচের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন।
‘এটা তো কলার খোসা!’
‘জি, এটা কলার খোসা। আর এটাই আপনার নাশতা।’
‘বুঝলাম না, আমাকে কলার খোসা খেতে দিয়েছেন কেন? আর আমি কলার খোসা খাবই-বা কেন?’

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম। এবারও ভাই উত্তর দিলেন না। উত্তর দিলেন শাহজাহান। তিনি টেনে টেনে বললেন, ‘খান ভাই, খান। উপকার হবে। ভাই কি জানেন না ফলের খোসায় ভাইটামিন থাকে। দেখেন না, আমরা আপেল-আঙুর খোসাসহ খাই। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কলাও খোসাসহ খাওন দরকার। এটা খুবই দরকারি। এটা আপনারে করোনা থেকে রক্ষা করবে।’

আমিও নরম সুরে টেনে টেনে বললাম, ‘ঠিকই বলেছেন, শাহজাহান ভাই। ফল খোসাসহ খাওন দরকার। কাঁঠাল, নারকেল, বেল—এগুলোও খোসাসহ খাওন উচিত। খুবই দরকারি। এটা শুধু করোনা নয়, সবকিছু থেকে রক্ষা করবে।’
‘ভাই কি আবারও মশকরা করলেন?’
শাহজাহানের গলায় হতাশার সুর।
‘জি না, আমি সিরিয়াস।’

‘না, ইচ্ছা হলে মশকরা করতে পারেন। কোনো সমস্যা নাই। তবে কলার খোসাটা কিন্তু আপনাকে খাইতে হবে।’ মোলায়েম সুরে বললেন।
‘ভাই, আপনারা আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করছেন?’
‘রানা সাহেব, সামনের চেয়ারে বসেন। সব বলছি।’

ভাই রুবিক্স কিউব মেলাতে মেলাতে বললেন। কিন্তু আমি চেয়ারে না বসে দাঁড়িয়ে রইলাম। শাহজাহান আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, ‘তোরে না ভাই বইতে কইছে! চুপচাপ বইয়া পড়, না হইলে কিন্তু ভুঁড়ি নামায়ে দিমু।’

শাহজাহান এত আস্তে বললেন যে ভাই শাহজাহানের কথা শুনতে পাননি। ভাই রুবিক্স কিউব টেবিলের ওপর রেখে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট বের করলেন। তারপর সিগারেটটা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকতে থাকলেন। এরপর সিগারেটে আগুন না ধরিয়েই ঠোঁটের মাঝে ধরে কয়েকটা টান দিলেন এবং ধোঁয়া ছাড়ার ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছাড়তে থাকলেন।

‘বুঝলেন রানা সাহেব, মেয়েমানুষ বড়ই কঠিন জিনিস। একবার যদি বুঝতে পারে আপনি তার প্রেমে পড়ে গেছেন, তাহলে আপনি শেষ। একেবারে স্বৈরশাসক হয়ে যাবে। যা বলবে, আপনাকে তা-ই শুনতে হবে। আমার কোনো বদ নেশা নাই, শুধু এই সিগারেটটাই ছিল। কিন্তু এখন আর ধূমপান করতে পারি না। কারণ, সে পছন্দ করে না। কিন্তু অনেক দিনের অভ্যাস তো, তাই আগুন না লাগাইয়া টান দেই। বলেন, এতে কি আর তৃপ্তি মেটে?’

‘জি না ভাই, মেটে না।’ ভাইকে সমর্থন করে বললাম।
‘কিন্তু কিছুই করার নাই। জানেন, এ দুনিয়ায় আমি কাউরে ভয় পাই না। এ মহল্লায় একজন মানুষও নাই যে আমার সামনে দাঁড়ায়ে উঁচু গলায় কথা বলতে পারে। অথচ তার সামনে গেলেই আমি নিজেই বোবা হয়ে যাই। মনে হয় আমি বাংলা ভাষাই ভুলে গেছি। বড়ই জটিল সমস্যা।’

‘ভাই, এটা কোনো সমস্যাই না। আপনি বাংলা ভুলে গেলে ইংরেজিতে বলবেন। দরকার হলে চায়নিজও বলতে পারেন। ভাই, আপনি কি চায়নিজ জানেন? অবশ্য না জানলেও সমস্যা নাই। চায়নিজ ভাষা খুবই সহজ। আমি শিখিয়ে দিচ্ছি। আপনি যা বলবেন, তার সঙ্গে শুধু ং যোগ করে দেবেন। ব্যস হয়ে গেল। যেমন চিং চুং চাং। পিং পুং পাং।’
ভাই আমার কথার উত্তরে কিছুই বললেন না। তিনি শুধু অবাক হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। খেয়াল করে দেখলাম শাহজাহানও ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, ‘খবরদার, ভাইয়ের সঙ্গে মশকরা করবি না। একদম ভুঁড়ি নামায়ে দেব।’
‘বড় ভাই, আপনার এই চ্যালারে কিছু একটা বলেন তো। শুধুই তুই-তোকারি করে। আর বলে ভুঁড়ি নামায়ে দেবে। এটা কোন ধরনের ইয়ার্কি!’
‘রানা সাহেব, ও ইয়ার্কি করছে না। ও সিরিয়াস।’
‘বলেন কী! সে কি সত্যি সত্যি এ কাজ করবে।’
‘আমি বললেই করবে।’
‘মাই গড, এ তো দেখি খুনি ।’

‘না রানা সাহেব, শাহজাহান খুনি না। আসলে সে আগে কসাই ছিল। আর ভুঁড়ি নামানো ওর অতি প্রিয় কাজ। অনেক দিন হয় সে ওই কাজ বাদ দিয়েছে। কিন্তু এত দিনের অভ্যাস। তাই সব সময় ওর হাত নিশপিশ করে।’
‘বলেন কী! গরু-ছাগলের ভুঁড়ি আর মানুষের ভুঁড়ি কি এক কথা হলো?’
‘ওর কাছে সব ভুঁড়িই এক।’

এতক্ষণ ব্যাপারটি সাধারণ মনে হলেও এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে যাই। মানুষের চোখ, কান, হাত, পা, কিডনি দুটো করে। একটা হারালে অন্যটা দিয়ে কাজ চালানো যাবে। কিন্তু ভুঁড়ি তো একটা। এটা ফেলে দিলে কীভাবে চলবে।

‘ভাই, কিছু মনে করবেন না। আমি কি জানতে পারি আমারে কেন ধরে আনছেন?’
‘অবশ্যই পারেন। আপনাকে ধরে আনা হয়েছে, কারণ, একটু আগে আপনি একটা অন্যায় করেছেন।’

‘কীভাবে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
‘একটু আগে আপনি পাশের দোকান থেকে একটা কলা খেয়েছেন, তাই না?’
‘ভাই, কলা খাওয়া কি অন্যায়?’

‘না, কলা খাওয়া অন্যায় নয়। কলা খেয়ে খোসা রাস্তায় ফেলাটা অন্যায়। আপনি সেই অন্যায় কাজটিই করেছেন। তাই তার শাস্তি হিসেবে আপনাকে আপনার ফেলে দেওয়া কলার খোসাটিই খেতে দেওয়া হয়েছে।’

‘ভাই, আমি কলার খোসা ফেলেছি, তাতে আপনার সমস্যা কী? আপনি কি এ এলাকার কমিশনার?’

আমার এই প্রশ্ন শুনে ভাই কিছুই বললেন না। তিনি শুধু শাহজাহানের দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে শাহজাহান আর মোটা বাবুল আমাকে চ্যাংদোলা করে উঠিয়ে ফেললেন। এরপর ওরা আমাকে পাশের ডাস্টবিনের ময়লার মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিলেন। আমি অবাক হয়ে শাহজাহানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শাহজাহান সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই যে এখন যেখানে শুইয়া আছস, এটার নাম ডাস্টবিন। দেখ কত বড় ডাস্টবিন। ময়লা রাস্তায় না, এখন থেকে এখানে ফেলবি। আর শোন, তুই এখন পুরা এক মিনিট এই ডাস্টবিনের মধ্যে বসে থাকবি। নে এক দুই করে গণনা শুরু কর। ষাট পর্যন্ত গণনা শেষ হলেই তারপর উঠবি।’

‘ভাই আপনারা আমার সঙ্গে এমন কেন করছেন?’
‘সত্তর পর্যন্ত গণনা করবি ।’
‘শাহজাহান ভাই, আমারে ক্ষমা করেন। আমাকে ছেড়ে দিন।’
‘আশি পর্যন্ত।’

বুঝলাম ওকে কিছু বলে লাভ হবে না। কারণ, কথা বললেই গণনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই আর কথা না বলে গণনা শুরু করলাম। গণনা শেষে তারা আমাকে আবারও ভাইয়ের সামনে নিয়ে এলেন। ভাই আমাকে নরম সুরে বললেন, ‘রানা সাহেব, আমার এলাকায় ময়লা-আবর্জনা কেউ রাস্তায় ফেলে না। অথচ আপনি ফেলছেন। এটা ভীষণ অন্যায়।’
‘ভাই, আমি জানতাম না এটা আপনার এলাকা। ভাই, আপনি কি এই এলাকা কিনে নিয়েছেন?’

ভাই এবারও আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি আবার শাহজাহানের দিকে তাকালেন। শাহজাহান ও মোটা বাবুল আবার আমাকে চ্যাংদোলা করে উঠিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন। আমি শাহজাহানের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ভাই, কত পর্যন্ত গুনব?’
‘নব্বই।’

গণনা শেষে আবার ভাইয়ের সামনে নিয়ে গেলেন। আমি ঠিক করলাম, ভাইরে আর কোনো প্রশ্নই করব না। ভাই বললেন, ‘রানা সাহেব, আপনি এই এলাকায় কেন এসেছেন?’

‘ভাই, এ এলাকায় নতুন একটি টিউশনি পেয়েছি। আজই প্রথম এলাম। ভাবলাম টিউশনিতে ঢোকার আগে কিছু খাই। তাই কলা খেয়েছিলাম।’

‘ভালো, খুবই ভালো। তার মানে, আপনি শিক্ষক। আমি শিক্ষকদের খুবই সম্মান করি। একটা কথা মনে রাখবেন, আমার এলাকায় কখনো অনিয়ম করা যাবে না। রাস্তাঘাটে ময়লা ফেলা যাবে না। ভবিষ্যতে এটা মনে রাখবেন।’

‘ঠিক আছে, মনে রাখব। তা ভাই, আপনার এলাকার সীমানা কতটুকু?’
প্রশ্ন করেই বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি। তাই তাড়াতাড়ি কাভার দেওয়ার জন্য বললাম, ‘ভাই, শুধু জানার জন্য প্রশ্ন করেছি। কিছু মিন করে করিনি। আপনার এলাকার সীমানা কতটুকু, জানা থাকলে সুবিধা হতো। তাহলে ভবিষ্যতে ময়লা ফেললে এই এলাকার বাইরে গিয়ে ফেলতাম।’

ভাই আমার কথা শুনে কিছুই বললেন না। তিনি আবারও শাহজানের দিকে তাকালেন। শাহজাহান আমাকে ধরার আগেই আমি দৌড় দিয়ে ডাস্টবিনের মধ্যে বসে এক দুই করে গণনা শুরু করলাম। শাহজাহান এসে আমাকে ডাস্টবিন থেকে বের হতে বললেন। আমি বের হতেই শাহজাহান এবং মোটা বাবুল আমাকে চ্যাংদোলা করে তুলে ডাস্টবিনের মধ্যে আবার ছুড়ে ফেললেন।

আমি অবাক হয়ে শাহজাহানকে প্রশ্ন করলাম, ‘ভাই, আমি তো ডাস্টবিনের মধ্যেই ছিলাম। খামাকা আমাকে বের হতে বলে আবার ফেলে দিলেন কেন?’

‘তুই একা একা ঢুকলে তো হবে না। আমরা ফেলব। এটা আমাদের দায়িত্ব। নে, এবার এক শ পর্যন্ত গুইনা ফেল।’

গণনা শেষে আবার আমাকে ভাইয়ের সামনে নিয়ে এল। এবার আমি ঠিক করলাম কোনো কথাই বলব না। যা বলে বলুক, চুপচাপ শুনব। কোনো প্রশ্ন করব না, কোনো উত্তর দেব না।

ভাই বললেন, ‘রানা সাহেব, আপনার নামটা খুউব সুন্দর। আপনি শিক্ষিত। ছাত্র মানুষ। আপনার কাজকর্ম হবে সুন্দর। আপনারাই দেশ গড়বেন। সমাজ সুন্দর করবেন। ঠিক না?’

আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলাম। ভাই আবার বললেন, ‘আপনি কি রাগ করেছেন? রাগ করা স্বাভাবিক। আপনাকে অপমান করার কোনো ইচ্ছা আমাদের ছিল না। কিন্তু আপনাকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার ছিল। তাই আপনাকে ধরে আনা হয়েছে। আপনি কি আপনার ভুল স্বীকার করেন?’

আমি এবারও কোনো উত্তর দিলাম না। ভাই শাহজাহানের দিকে তাকালেন। তারা আবার আমাকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিলেন। এবার আমাকে এক শ দশ পর্যন্ত গণনা করতে হলো।

আমি কী করব বুঝতে পারছি না। এরা আমি প্রশ্ন করলেও ফেলে দেয়, না করলেও ফেলে দেয়। কথা বললেও ডাস্টবিনে ফেলে, না বললেও ফেলে। এ থেকে মুক্তির পথ কী, আমি জানি না। ঠিক করলাম, সরাসরি মাফ চাইব। ভাইয়ের সামনে গিয়ে সরাসরি বললাম, ‘ভাই, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আর কখনো কোথাও এমন কাজ করব না। প্রয়োজনে জীবনেও আর কলা খাব না। এমনকি যে পরিবার কলা খায়, সে পরিবারের মেয়েকে বিয়ে পর্যন্ত করব না। আমাকে এবার মাফ করে দেন।’
‘ঠিক আছে, আপনাকে মাফ করে দেব। কিন্তু একটা শর্ত আছে।’
‘ভাই, আমি আপনার সব শর্ত মানব। আপনি বলেন।’

‘যেহেতু আপনি পরিবেশ নষ্ট করেছেন, সেহেতু এখন পরিবেশসচেতনতামূলক অথবা দেশাত্মবোধক একটা গান আমাদের গেয়ে শোনাবেন।’

‘ভাই, আমি তো গান গাইতে পারি না। আমার তাল-সুরের কোনো জ্ঞান নাই। যার কারণে আমি বাথরুমে বসেও গান গাই না।’

‘কোনো সমস্যা নাই। আপনি যা-ই গাইবেন, তাকেই আমরা গান ধরে নেব। নেন, শুরু করেন।’

‘ঠিক আছে, ভাই, তাহলে পরিবেশ নিয়ে একটা গান গাই।’

ভাই মাথা ঝাঁকালেন। আমি কঠিন সুরে গান ধরলাম, ‘রূপে আমার আগুন জ্বলে, যৌবন ভরা অঙ্গে/ প্রেমের সুধা পান করে নাও/ হায় রে আমার দিওয়ানা, ও আমার মাস্তানা। রূপে আমার আগুন...।’

এ পর্যন্ত গাইতেই ভাই হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ভাই, কোনো সমস্যা?’
‘এটা আপনের পরিবেশের গান!’
‘জি ভাই।’
‘আপনি কি শিওর?’

‘জি ভাই, আমি এক শ ভাগ শিওর। কোনো ডাউট নাই।’
‘এটা কীভাবে পরিবেশের গান হলো, ব্যাখ্যা করতে পারবেন?’
‘জি ভাই, পারব। ভাই, আলোচ্য গানটি বাংলা “বেদ্বীন” সিনেমা থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে নায়িকা নেচে নেচে তার শরীরে যে আগুন লেগেছে, তা ব্যক্ত করছেন। ভাই, খেয়াল করেন, এই গানে যে আগুনের কথা বলা হয়েছে, তা কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের ফল। পরিবেশের বিপর্যয়ের কারণেই দুনিয়ায় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। যার কারণে যেখানে-সেখানে আগুন লাগছে। আপনি নিশ্চয়ই খবরে দেখেছেন অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। কিছুদিন আগে আমাজন জঙ্গলেও আগুন লেগেছিল।’
‘রানা সাহেব, আমাজন জঙ্গলের আগুন আর নায়িকার যৌবনের আগুন কি এক? এখানে নায়িকা যে আগুনের কথা বলছে, তার মানে...’
ভাইকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বললাম, ‘এই আগুনের মানে আমি জানি, ভাই। পরিবেশের উষ্ণতার কারণেই শরীরে এই আগুন লাগছে। গাছ না কেটে বেশি বেশি গাছ লাগালে কিন্তু পরিবেশ উষ্ণ হতো না, আর নায়িকার শরীরেও আগুন লাগত না। ভাই, আপনি খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, কিছুদিন আগে হিন্দি সিনেমা “স্ট্রিট ড্যান্সার”-এ নায়িকা নোরা ফাতেহি আপা গরমের যন্ত্রণায় লাফিয়ে লাফিয়ে গান গেয়ে তার কষ্টের কথা বলেছেন।’

‘তাই নাকি! তা আপনার নুরা আপা কী বলেছেন?’ শাহজাহান ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন।

‘তিনি গরমের যন্ত্রণায় যা বলেছেন, তা এখন আমি আপনাদের গেয়ে শোনাচ্ছি।’
এরপর আমি শরীরটাকে একটু বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে গান ধরলাম,
‘হাই গরমি, হাই গরমি...পারা ইতনা হাই হুয়া কে,
থার্মোমিটার টুট গ্যায়া, সাইয়া জি কি টপক টপকে, হ্যায় পাসিনা ছুট গ্যায়া।...হায় গরমি, হায় গরমি।’

ভাই আবারও হাত উঠিয়ে আমার গান থামিয়ে দিলেন। আমি গান থামিয়ে বললাম, ‘ভাই, এই যে নোরা আপার শরীরের গরম, সেটা কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণেই। এ গানের দ্বারা নোরা আপা লাফিয়ে লাফিয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা বলছেন। তাই ভাই, গাছ লাগাতেই হবে। যেখানে-সেখানে গাছ লাগাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই।’
ভাই কোনো কথা না বলে ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর তিনি দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়লেন। তারপর হতাশ হয়ে শাহজাহানের দিকে তাকালেন। বুঝলাম, আমাকে এরা আবারও ডাস্টবিনে ফেলে দেবে। আমি ভয়ে ভয়ে শাহাজানের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘শাহজাহান ভাই, এইবার একটু আস্তে ফেইলেন। অলরেডি মাজায় ব্যথা পেয়েছি।’

‘চুপ ব্যাটা ফাজিল, তুই কোনো কথা কইবি না। তোরে ফেলতে ফেলতে আমাদেরই হাত ব্যথা হইয়া গেছে।’ শাহজাহান ধমক দিয়ে বললেন।

ভাই হাত তুলে শাহজাহানকে মানা করলেন, ‘শাহজাহান, থাক, এবার ফেলতে হবে না। ওনাকে আরেকটা সুযোগ দিলাম। নেন, এবার একটা দেশের গান করেন।’
হঠাৎ কেন জানি ভয়ে শুধু দেশের গান নয়, কোনো গানই আর মনে পড়ছে না। অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর একটা গান মনে পড়ল। কিন্তু গানটি দেশের গান কি না, সেটা নিয়ে আমি কিছুটা কনফিউজড। তাই গানটিকে দেশের গানের একটা আবহ দেওয়ার জন্য গলায় একটা কান্না কান্না ভাব এনে আবেগ দিয়ে গান শুরু করলাম—
‘বিদেশ গিয়া বন্ধু, তুমি আমায় ভুইল না,/ চিঠি দিও পত্র দিও জানাইও ঠিকানা রে জানাইও ঠিকানা। ওরে ও পরদেশি, পরদেশি। যাবার আগে দোহাই লাগে একবার ফিরে চাও,/ আবার তুমি আসবে ফিরে আমায় কথা দাও, আমায় কথা দাও...’
এ পর্যন্ত গেয়ে নিজেই গান থামিয়ে দিলাম। দেখলাম এবার শুধু বড় ভাই না, বড় ভাই, শাহজাহান, মোটা বাবুল—তিনজনই ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বুঝলাম, ভেজাল হয়ে গেছে। বিপদ থেকে বাঁচার জন্য ভাই মুখ খোলার আগে আমি দ্রুত বললাম, ‘ভাই, এবার কিন্তু হয়েছে। এবার আর ভুল করিনি। এটা কিন্তু এক শ ভাগ দেশের গান। কারণ, এখানে নায়িকা নায়কের বিদেশে গেলেও দেশকে ভুলতে মানা করছেন। বলছেন চিঠি দিয়ে দেশের খোঁজখবর রাখতে।’

দেখলাম ভাই একইভাবে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। শাহজাহান আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘অই ব্যাটা, তুই প্রেমের গানটাকে দেশের গান বানায় ফেললি! আর তুই কয়টা গান একসঙ্গে মিলায়া গাইলি?’
আমি মিনমিন করে বললাম, ‘কেন, হয় নাই?’
শাহজাহান আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বললেন, ‘ভাই, এরে আর কতবার ডাস্টবিনে ফেলব? এই ব্যাটার তো মাথায় সমস্যা আছে। ভাই, এক কাজ করি, এই ব্যাটারে আমাদের ক্লাবের পাশের পুকুরে ফেলায় দিয়ে আসি?’

ভাই হতাশ হয়ে বললেন, ‘যা ভালো মনে করিস, কর। এর ব্যাপারে আমি আর নাই। এই ব্যাটারে আমার সামনে থেকে সরিয়ে নে। আর শোন, এই ব্যাটা যেন আমার এলাকার কোনো ছাত্রছাত্রীকে পড়াতে না আসে, সেটা তোরা খেয়াল রাখবি। কারণ, আমি শিওর, এ ব্যাটা উল্টাপাল্টা জিনিস পড়াইয়া এলাকার পোলাপাইনের মাথা খারাপ করে দেবে।’
ভাইয়ের নির্দেশ পাওয়ামাত্র শাহজাহান আর মোটা বাবুল আমাকে চ্যাংদোলা করে তুলে পুকুরের দিকে রওনা দিলেন। আমি বুঝতে পারছি না আমার গানে সমস্যা কোথায়? আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘শাহজাহান ভাই, আরেকটা গান মনে পড়ছে, যদি অনুমতি দেন তো গেয়ে শোনাই?’

আমার কথা শুনে শাহজাহান আর মোটা বাবুল হাঁটা বন্ধ করে দিলেন। চ্যাংদোলা অবস্থায় আমার চোখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে শাহাজাহান বললেন, ‘খ-ব-র-দা-র, তুই শুধু আইজ না, এই জীবনেও আর গান গাওয়ার চেষ্টা করবি না। গান গাওয়া তোর জন্য হারাম।’
‘ঠিক আছে, গাইব না। ভাই, অনুমতি দিলে একটা কথা বলতাম।’
‘কইয়া ফেল।’
‘শাহজাহান ভাই, আপনারা কি আসলেই আমার পুকুরে ফেলবেন?’
‘তোর কী ধারণা?’
‘আমার ধারণা, আপনারা অবশ্যই আমারে পুকুরে ফেলবেন। তা ভাই, পুকুরে ফেলবেন, ফেলেন, সমস্যা নাই। তবে একটু কিনারের দিকে ফেইলেন। আমি কিন্তু সাঁতার জানি না।’
শাহাজাহান বা মোটা বাবুল কেউই আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। তারা তাদের মতো আমাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন।

বি. দ্রষ্টব্য:
প্রতিটি এলাকায় যদি বড় ভাইয়ের মতো এমন বড় ভাই থাকত, তাহলে দেশটা আরও সুন্দর হতো। বড় ভাই মানেই সন্ত্রাসী হতে হবে, এর তো কোনো মানে নেই।

বি. দ্রষ্টব্য:
যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলাটা আমাদের বন্ধ করতে হবে। দেশটাকে সুন্দর রাখতে হবে। আমি জানি আমরা পারব। বাংলাদেশের মানুষ চাইলে সবই পারে।

*নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]