ঘুরে এলাম স্বপ্নের হাওর ডিঙ্গাপোতা

ডিঙ্গাপোতা হাওর। মোহনগঞ্জ উপজেলা, তথা নেত্রকোনার অন্যতম শস্যভান্ডার। ডিঙ্গাপোতা মোহনগঞ্জের মানুষকে তার সমস্ত প্রাণশক্তি, ভালোবাসা আর সম্পদ উজাড় করে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। মোহনগঞ্জের মানুষও এটা ভালো করেই জানে। আর তাই তারাও অসম্ভব ভালোবাসে ডিঙ্গাপোতাকে।

৮ এপ্রিল হঠাৎ করেই ঘুরে এলাম ডিঙ্গাপোতা হাওর। কয়েক দিন আগে হঠাৎ এক সন্ধ্যায় বৃষ্টিহীন এক ঝোড়ো বাতাস দেশের কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। অনেকটা ধূলিঝড়ের মতো। জেলাগুলোর মধ্যে নেত্রকোনাও একটি। অল্পক্ষণের বিষয়। কিন্তু এর ফলে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশ। বিশেষ করে নেত্রকোনার কিছু কিছু জায়গার ফসলের ক্ষতি হয়। নেত্রকোনা শহরে আলোচনা হচ্ছিল যে এ বাতাসের ফলে বিভিন্ন এলাকার, বিশেষ করে মদন ও মোহনগঞ্জের অনেক এলাকায় ধানখেত পুড়ে গেছে। মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে চাকরির সুবাদে আমার মোহনগঞ্জে তো যেতে হয়ই। স্কুলের কাজের পাশাপাশি আমার কোভিড-১৯ টিকা নেওয়ার তারিখ ছিল ৮ এপ্রিল। আমাদের পাইলট স্কুলের উচ্চমান সহকারী আবদুল্লাহ যুবায়েরের মোটরসাইকেলে মোহনগঞ্জে যাওয়ার পথে দুজনেই রাস্তার দুই পাশের  ধানখেতগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। ক্ষতি হয়েছে, এমন ধানখেত চোখে পড়ল খুব কমই।

আর যে এক–দুটি ধানখেত এমন আছে, তার মধ্যেও যৎসামান্য ক্ষতি হয়েছে; বরং দুই পাশের জমিগুলো দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। এত সুন্দর ফসল হয়েছে যে মনে হলো মহান আল্লাহ তায়ালা দুহাত ভরে এ দেশের মানুষের ওপর রহমতস্বরূপ অফুরন্ত ফসল দিয়েছেন। এত সুন্দর ফসল দেখে একটা কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। ২০১০ সালে প্রশিক্ষণের সুবাদে আমেরিকায় গিয়েছিলাম। সময়টা ছিল ফেব্রুয়ারির ১ থেকে মার্চের ২১ তারিখ পর্যন্ত। সে সময় দেখেছি, সেখানকার কৃষিজমিগুলো দীর্ঘদিন ধরে বরফে ঢাকা থাকে। চাষাবাদ করা তো দূরের কথা, তখন মানুষের ঘর থেকে বের হওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সে তুলনায় আমাদের মহান আল্লাহ তায়ালা কত রহমত দান করেছেন! তা না হলে এত ঘনবসতিপূর্ণ দেশের মানুষের কী অবস্থা হতো, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন।

যাহোক, স্কুলে পৌঁছে কিছুক্ষণ কাজ করে আমরা হাসপাতালে গেলাম। এরপর টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে আবার স্কুলে এসে স্কুলের কাজকর্ম সারতে গিয়ে দেখলাম, বিকেল হয়ে গেছে। আবার মোটরসাইকেলে নেত্রকোনার উদ্দেশে রওনা দিয়ে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এসে যুবায়ের সাহেবকে বললাম, ‘ডিঙ্গাপোতা হাওরে গিয়ে একটু ক্ষতিগ্রস্ত জমিগুলো দেখে এলে ভালো হতো না?’ যুবায়ের সাহেব সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে হোন্ডা ঘুরিয়ে ফেললেন। আমি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মু. রানা আসিফের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে ক্ষতিগ্রস্ত জমি দেখতে হলে অনেক দূরের পথ শ্যামপুর পর্যন্ত যেতে হতে পারে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রয়োজনে আরও দূরে যাব। তবু নিজ চোখে দেখে আসব ফসলের ক্ষতি কতটা হয়েছে।

আমরা মোহনগঞ্জ থেকে তেঁতুলিয়া গেলাম। এরপরই ডিঙ্গাপোতা হাওর শুরু। হাওরের দিকে তাকিয়ে মনটা ভরে গেল। একেবারে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। যত দূর চোখ যায় শুধু ধানখেত আর ধানখেত। সোনালি ফসলের অসাধারণ এক সমাহার। দৃষ্টি ফেরানো দায়। যাহোক, আমরা এগিয়ে চললাম শ্যামপুরের দিকে। পাকা রাস্তা হলেও মাঝেমধ্যেই ভাঙা। তবু সোনালি মাঠের মধ্য দিয়ে যেতে খুব ভালোই লাগছিল। মাঠে আমাদের অর্থনীতির যাঁরা একেবারে প্রাণভোমরা, সেই কৃষকেরা ফসল তোলায় ব্যস্ত। আর ব্যস্ত হবেনই–না কেন? এই ফসলই যে তাঁদের সারা বছরের খেয়ে–পরে বেঁচে থাকার সম্বল। ফসলটা ঠিকমতো না তুলতে পারলে তাঁদের দুর্গতির তো শেষ থাকবে না। শুধু তাঁরা কেন, মহাবিপদে পড়তে বাধ্য দেশের পুরো অর্থনীতি। তাই তাঁরা চান, যেকোনো মূল্যে ভালোভাবে ফসলটা ঘরে তুলতে। সারা দিন কাজ করছেন বিরতিহীনভাবে। বলা যায়, তাঁরাই আমাদের দেশের খাদ্যের আসল জোগানদাতা।

আমরা নোয়াগাঁও পর্যন্ত গেলাম। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত ধানখেতের খোঁজ পাচ্ছিলাম না। মাঠের কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম, ক্ষতিটা আসলে তেমনভাবে হয়নি। অল্প কিছু জমি, যেগুলোতে ধানের শিষ মাত্র বের হচ্ছিল, সেগুলোর কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে এমন জমির পরিমাণ খুব কম। আমরা দেখলাম, অধিকাংশ জমির ধান পেকে গেছে। আর এক সপ্তাহের মধ্যেই সিংহভাগ জমির ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। শুনে ও দেখে খুব ভালো লাগল। হাওরে খুব ভালো ফসল হয়েছে। আর কৃষকেরা দামও পাচ্ছেন ভালো। তাঁরাও বেশ সন্তুষ্ট। এখন ভালোয় ভালোয় ফসলটা ঘরে তুলতে পারলেই হয়।

আমাদের পরিকল্পনা ছিল শ্যামপুর থেকে ফিরে আসব। কিন্তু ফেরা আর হলো না। ততক্ষণে আমরা হাওর দেখার নেশায় পড়ে গেছি। শ্যামপুর স্কুল আর শ্যামপুর বাজার বাঁয়ে ফেলে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চললাম। একটু এগিয়েই গেরিয়াহাই গ্রামের পাশে সুন্দর আশ্রায়ণকেন্দ্র। আশ্রায়ণ প্রকল্পের সঙ্গেই বেশ বড় একটা খালি মাঠ। একসময় হয়তো এসব জায়গায় শত শত গরুর পাল দেখা যেত। এখন চাষাবাদে আধুনিক যন্ত্র যোগ হওয়ায় কৃষকেরা আর আগের মতো গরু পালন করেন না। গরুর পালও আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবু পরবর্তী সময়ে একটু এগিয়ে ছোট এক–দুটি গরুর পাল দেখেছিলাম।

এরপর আশ্রায়ণ প্রকল্পের পশ্চিম পাশ দিয়ে হাওর বরাবর বদরখালী টুনাই নদের পাড় হয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে চলে গেলাম বরান্তর। বরান্তর যাওয়ার পথে টুনাই নদে একদল লোককে মাছ ধরতে দেখলাম। তাঁদের সঙ্গে মাছ ধরার জাল বা এ রকম কোনো সরঞ্জাম ছিল না। এমনকি মাছ রাখার মতো কোনো কিছু ছিল না। সারা দিন কাজ করে বিকেলবেলা একটু সময় পেয়ে তাঁরা নদে নেমে পড়েছেন, যদি হাত দিয়ে কিছু মাছ ধরা যায়। হাওরে পানি নেওয়ার জন্য যে কলসিটা ছিল, সেটাকেই মাছ রাখার জন্য ব্যবহার করছেন। হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, তা–ই কাজে লাগানোর ভালো বুদ্ধিই বটে। পানির ওপর ভেসে ভেসে কলসিটাও তাঁদেরকে বেশ ভালোভাবেই সহায়তা করছিল। কী চমৎকার দৃশ্য।

যাহোক, বরান্তর পৌঁছে বাজার আর হাইস্কুলটা দেখলাম। সেখানে দেরি না করে হাওর বরাবর রাস্তা দিয়ে চলে গেলাম করাচাপুর বাজার। করাচাপুর হাইস্কুলটাকে দেখে এখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। এরপর ভাটিয়া, নারাইচ ও মল্লিকপুর হয়ে আবার ডিঙ্গাপোতা হাওর বরাবর রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর কিছু ক্ষতিগ্রস্ত ধানখেত দেখতে পেলাম। তবে যা দেখলাম তাতে বলা যায়, তুলনামূলকভাবে ক্ষতিটা কমই হয়েছে। তবু ক্ষতি তো ক্ষতিই। সার্বিকভাবে ক্ষতি কম হলেও যাঁর জমির ফসলটা গেছে, তাঁর জন্য তো বিপদই। হয়তো পরিবার–পরিজন নিয়ে কষ্টেই কাটাতে হবে সামনের বেশ কিছুদিন।

শেওড়াতলী গ্রামের দিকে চলে গেছে যে রাস্তাটা, সেটা ধরে কিছুক্ষণ এগুলোই চোখে পড়ল গোড়াউত্রা নদী খননের বিশাল প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টের কাজ সফলভাবে সমাপ্ত হলে সেচসুবিধা পাবেন সেখানকার কৃষকেরা। এতে স্থানীয় কৃষকদের উপকার পাওয়ার পাশাপাশি দেশের খাদ্যনিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে, এমনটা আশা করাই যায়। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে তা–ই জানলাম।

একটা বিষয় আমার খুব ভালো লাগল। প্রত্যন্ত এলাকার হাওরের ছোট্ট ছোট্ট রাস্তাগুলো, যেগুলোকে আমাদের এলাকায় গোবাট বলা হয়, সেগুলোকে পাকা করে দেওয়া হয়েছে। বর্ষাকালে এগুলো ১০–১৫ ফুট পানির নিচে থাকে। কিন্তু এখন এগুলো শস্য পরিবহনে খুবই কাজে আসছে। মানুষের যাতায়াত ছাড়াও ধান কাটার বেশ বড় বড় মেশিন, শস্য পরিবহনের জন্য বিভিন্ন রকম গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আসলে কৃষির আধুনিকায়নে যোগাযোগব্যবস্থা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা বলাই বাহুল্য। আমি মনে করি, এই রাস্তাগুলো মোহনগঞ্জের কৃষিজীবী মানুষের জীবনযাত্রা একেবারে পাল্টে দিয়েছে। সব অঞ্চলে এমন ব্যবস্থা করে দিতে পারলে আমাদের কৃষি অর্থনীতির চালচিত্রই পাল্টে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
হাওরের পাশের গ্রামগুলোতে অনেক জায়গায় দেখেছি, অনেকেই নতুন নতুন বাড়ি তৈরি করছেন। এমন অনেক বাড়িই হচ্ছে, যেগুলোতে বর্ষাকালে পানির ঢেউ সরাসরি প্রচণ্ডভাবে আছড়ে পড়বে। তখন এই বাড়িগুলোকে অক্ষত রাখাটা নিশ্চিতভাবেই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আমার চোখে এখনই ভাসছে এসব বাড়ির মানুষের জীবনসংগ্রামে মুখর সেই দিনগুলোর দৃশ্য। বাড়িগুলোকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে কতটা কষ্টই না করতে হবে তাঁদের! আমাদের মত যাঁরা হঠাৎ এক দিন বেড়াতে যাই, তাঁদের পক্ষে এসব মানুষের কষ্টের কথা কতটা বোঝা সম্ভব? আমাদের চোখে তো শুধু সুন্দর সুন্দর দৃশ্যগুলোই পড়ে। কিন্তু বাস্তবে হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবন কি এত সুন্দর, এত সাবলীল? হয়তো না। যাঁরা রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে মাছ ধরে আমাদের প্রোটিনের চাহিদা মেটান, তাঁদের কষ্টটাই–বা আমরা কতটুকু বুঝতে পারি? তবু তো প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করেই টিকে আছেন হাওরের লোকজন। টিকে থাকবেন সুখ-দুঃখ আর আনন্দ-বেদনার কাব্যময় জীবন নিয়ে।

অসাধারণ একটা দিন কাটালাম ডিঙ্গাপোতার চারপাশ ঘুরে। কিছুটা হলেও দেখা হলো সেখানকার মানুষ আর প্রকৃতিকে। সারা দিনে হোন্ডায় করে অতিক্রম করলাম দেড় শতাধিক কিলোমিটার রাস্তা। তবু ক্লান্তি আসেনি। বরং মনে হয়েছে জীবনের অন্যতম সুন্দর একটা দিন কাটাতে পেরেছি সেদিন। ধন্যবাদ যুবায়ের সাহেবকে এমন একটা সুন্দর জার্নির সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

শুকনা মৌসুমে ডিঙ্গাপোতা বাংলাদেশের অন্যতম শস্যভান্ডার। আবার বর্ষাকালে এই ডিঙ্গাপোতাই পরিণত হয় মৎস্যভান্ডারে। তখন উন্মত্ত যৌবনা ডিঙ্গাপোতা তার রূপ পাল্টে কিছুটা ভয়ংকর হয়ে উঠলেও তার সৌন্দর্যের কোনো কমতি থাকে না। বরং তখন তার রূপ উপচে পড়ে। সে তখনো তার চারপাশে বসবাসকারী মানুষকে অফুরন্ত সম্পদের ভান্ডার থেকে বঞ্চিত রাখে না। মায়ের মতো মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে তার সুনীল ভান্ডারকে অবারিত রাখে সবার জন্য। সবাইকে সুখে রাখাই যেন তার আজীবনের কাজ।

ডিঙ্গাপোতাকে ঘিরে মোহনগঞ্জের বিশাল জনগোষ্ঠীর যে আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ড, তা যেন কোনো দিন থেমে না যায়। ডিঙ্গাপোতা সমৃদ্ধ হলেই মোহনগঞ্জ সমৃদ্ধ হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিও হবে শক্তিশালী।

*লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত), মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা।