গুজব ঠেকাতে কী প্রয়োজন

মুখে মুখে রটে যাওয়া ভিত্তিহীন কথাকে আমরা গুজব বলে থাকি। এই রটে যাওয়া ভিত্তিহীন কথাই যখন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তখন গুজব আর গুজবের আকৃতিতে না থেকে গজবে পরিণত হয়। এমন গুজব নামের গজব খুব আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে ঘটে চলছে আমাদের চারপাশে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এখন একটি খবর খুব দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এখন প্রায় সবাই একটা খবর শেয়ার করার আগে খবরটি সত্য নাকি মিথ্যা, সেটা যাচাই করার মানসিকতা রাখে না। হাজারো খবরের ওয়েবসাইট। এসব ওয়েবসাইটে যারা খবর লেখে, তারাও অনেক সময় খবরের সত্যতা যাচাই করে না।

একজনের কাছে কোনো ভাসা-ভাসা তথ্য পেলেই নিউজ করে দেয়। আমরা লক্ষ করেছি, অনেকেই ফেসবুকে অনেক নিউজ শেয়ার করে, যেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। এমনকি যে ওয়েবসাইট থেকে নিউজ প্রকাশ করা হয়, সেটারও কোনো পরিচয় নেই। অথচ একটা খবর আমরা সত্যতা না জেনেই অন্যের কাছে শেয়ার করছি। বিষয়টা কখনোই সাধারণ নয়। এর চেয়ে ভয়ানক আর কিছু হতে পারে! আমার কাছে একটা খবর এল, আমি এটার সত্যতা না জেনে রসালভাবে অন্যের কাছে দিয়ে দিলাম। আর এসব মিথ্যা খবর ও তথ্যের জন্য অনেকেরই প্রাণহানি হচ্ছে।

গত কয়েক দিন হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ জাতীয় গণমাধ্যমে একটি খবর প্রচারিত হচ্ছে। গাইবান্ধায় এক বৃদ্ধা নাকি মৃত্যুর ৯ মাস পর কবর থেকে উঠে এসেছেন। শুধু চেহারার মিল থাকার কারণে অনুমানে দুজনকে এক ভেবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ খবর ঢালাওভাবে প্রচার করা হয়েছে। কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই খবরটি প্রচার করা হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার পর অবশেষে আসল খবর পাওয়া গেছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরুর দিকে দেশব্যাপী গুজব ছড়ানো হয়েছিল, পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা প্রয়োজন। সে গুজবের ওপরই ভিত্তি করে ঘটেছিল নানা নির্মম ঘটনা। বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা প্রত্যন্ত গ্রামে তাঁদের চাকরির সুবাদে কাজ করেন। তাঁদের হাতে ব্যাগ দেখে গ্রামের সাধারণ জনতা ছেলেধরা বলে গণধোলাই দিয়েছে, এ রকম খবর আমরা জাতীয় পত্রিকায় পড়েছি। রাজশাহীতে এই ছেলেধরা গুজবকে কাজে লাগিয়ে ঘটেছিল আরেকটি দুর্ঘটনা। দুই ব্যক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এক ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, অন্যজনকে মস্তকহীন করে ছাড়বে। আর কাজটা ছেলেধরা করেছে বলে চালিয়ে দেবে। যদিও ষড়যন্ত্র অবশেষে ফাঁস হয়েছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, গুজবকে অনেকেই কাজেও লাগাতে চায়।

সবচেয়ে বহুল আলোচিত ও হৃদয়বিদারক যে ঘটনা ঘটেছিল, তা হলো তাসলিমা বেগম নামের এক নারীকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা। শুধু দেশব্যাপী চলা এই গুজবের কারণেই এই নারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর সন্তান আজও তার মায়ের বাড়িতে ফেরার জন্য অপেক্ষা করছে।

রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং ধর্ম—কোনো ক্ষেত্রেই গুজব ছড়ানো বাদ নেই। সব জায়গায় সমানতালে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটি ভুয়া ও ভিত্তিহীন মিথ্যা সংবাদ খুব দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে একটি কুচক্রী মহল। এ ছাড়া বিকৃতমস্তিষ্কের অনেকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাময়িক পৈশাচিক আনন্দ উপভোগের জন্য মানুষকে হেনস্তা করে, যা অনেকেরই সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সর্বশেষ সবার প্রতি মুক্ত আবেদন, কোনো খবর প্রচার করার আগে অবশ্যই সেটার তথ্যসূত্র খাঁটি কি না, যাচাই করে নেব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শত শত বিষয় মানুষ প্রচার করে, কে কোন মনোভাব নিয়ে প্রচার করেছে, সেসব বিষয় লক্ষ রাখব। ধর্মীয় কোনো বিষয় প্রচার করার আগে ধর্মীয় নেতাদের কাছে সত্যায়ন করে নেব। অন্য যেকোনো বিষয়ও প্রচারের আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ—এমন ব্যক্তিকে দিয়ে বিষয়টার সত্যতা যাচাই করে নেব। গুজবের কারণে যেন আর কাউকে প্রাণ হারাতে না হয় এবং কাউকে যেন স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন না হতে হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়