২৬২ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘হুমগুটি’ খেলায় মানুষের ঢল

‘হুমগুটি’ খেলায় মানুষের ঢল। কিন্তু করোনাকালে কেউ  মাস্ক পরেননি
ছবি: লেখক

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়লে, ক্রমেই ভাইরাসটি মহামারি আকারে সংক্রমণ দূত বিশ্বের প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের কথা জানায় সরকার। দেখতে দেখতে প্রায় ১ বছর পেরিয়ে গেল করোনার সময়ে রুগ্‌ণ এই পৃথিবীর বয়স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষ জীবন বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলার, নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করা, সভা-অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার মতো জনসমাগম এড়িয়ে চলতে। করোনার এই মহামারিতে প্রাণ হারিয়েছে পৃথিবীর বহু মানুষ, ইতিমধ্যে বাংলাদেশও হারিয়েছে অনেক গুণী মানুষকে। তবু যেকোনো উৎসবে বাঙালি জনতা বিশেষ করে গ্রামবাংলার মানুষ এখনো কোনো না কোনো গ্রামীণ পূজা–পার্বণে পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনটি উদ্‌যাপন করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কেননা, বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি বিস্তর জায়গাজুড়ে রয়েছে লোকজ সংস্কৃতি।

বলছিলাম ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার প্রায় ২৬২ বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি খেলার কথা। অদ্ভুত এই খেলার নাম হুমগুটি খেলা। পুরো উপজেলাসহ আশপাশের চার-পাঁচটি উপজেলা থেকে হাজারো মানুষের সমাগমে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল খেলাটি।

ফুলবাড়িয়ার দেওখোলা ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের তালুক-পরগনা সীমানায় গত বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) বেলা আড়াইটায় শুরু হয় ২৬২তম হুমগুটি খেলা। করোনার কারণে স্থানীয় প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করেই কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই খেলা অনুষ্ঠিত হয়। যদিও অন্যান্য বছরের তুলনায় প্রথম দিকে এবারের খেলোয়াড়ের উপস্থিতি কম থাকলেও সন্ধ্যা হতে না হতেই হাজারো খেলোয়াড়ের ঢল নামে লক্ষ্মীপুরের বড়ই আটা বন্ধে (ফসল কাটার পর বিস্তৃত ভূমি)।

জনশ্রুতি আছে, প্রজাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য নাকি জমিদারেরা একটি খেলার প্রচলন করেছিলেন, যার স্থানীয় নাম ‘হুমগুটি’। কোন এলাকার মানুষের শক্তি কত বেশি, কোন এলাকায় রয়েছে পরগনার সবচেয়ে শক্তিশালী পালোয়ানেরা, তা জানা যায় এ খেলায়। হুমগুটি হচ্ছে পিতলের তৈরি ৪০ কেজি ওজনের গোলাকার একটি বস্তু। এ বস্তু নিয়ে হাজারো মানুষ কাড়াকাড়িতে মেতে থাকে। সবার মুখে উচ্চারিত হয়, ‘জিতই আবা দিয়া গুটি ধররে হেইও...’

খেলায় ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেদের শক্তি পরীক্ষায় জন্য খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে শতাধিক খেলোয়াড়ের দল গুটি নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে। খেলা শুরু হয় উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত হয়ে। রাত যত গভীর হয়, খেলা ততই জমে ওঠে। এবারের খেলাটি ছিল ২৬২তম আসর।

হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে এবারও অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় ও হাজারো দর্শকের উপচেপড়া ভিড় ছিল খেলায়। খেলাকে কেন্দ্র করে উপজেলার লক্ষ্মীপুর, দেওখোলা, বালিয়ান, ফুলবাড়িয়া, কাতলাসেনসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোয় দুদিন আগে থেকেই খেলার দিন পর্যন্ত চলে উৎসবের আমেজ।

জনশ্রুতি আছে, প্রজাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য নাকি জমিদারেরা এই ‘হুমগুটি’ খেলার প্রচলন করেছিলেন
ছবি: লেখক

কথিত আছে, মুক্তাগাছার জমিদার শশীকান্তের সঙ্গে ত্রিশালের বৈলরের জমিদার হেমচন্দ্র রায়ের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে প্রজাদের মধ্যে শক্তি পরীক্ষা ও জমির পরিমাপের বিষয় নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসাকল্পে এমন অদ্ভুত খেলার প্রচলন হয়। উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে লক্ষ্মীপুর ও ১০ মাইলের মাঝামাঝি বড়ই আটা বন্ধ নামক বড় মাঠ হলো খেলার কেন্দ্রস্থল। জায়গাটি মুক্তাগাছা-ত্রিশাল জমিদার আমলে তালুক (৯ শতাংশে ১ কাঠা) বনাম পরগনার (সাড়ে ৬ শতাংশে ১ কাঠা) সীমানা ছিল।

স্থানীয় মোড়ল পরিবার ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর পৌষের শেষ বিকেলে হুমগুটি খেলা চালিয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন মোড়ল পরিবারের সদস্য আবুবক্কর সিদ্দিক (৫৫)।

পৌষ মাসের শেষ দিনকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় পুহুরা। এদিনেই অনুষ্ঠিত হয় হুমগুটি খেলা। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ভাগ-বাঁটোয়ারা করে খেলা শুরু হলেও পরে আর কোনো দিক থাকে না খেলোয়াড়দের। পিতলের গুটি মাঠে আসার পরই এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজারো জনতা। টানাহেঁচড়া–ধাক্কাধাক্কি সবই হয় এ খেলায়। অনেক সময় এই খেলায় অংশ নিতে এসে পদদলিত হয়ে মারাও গেছেন অনেকে। তবু গ্রামের মানুষ এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো বিনোদনের খোরাকের পাশাপাশি কোন ইউনিয়নের মানুষ বেশি শক্তিশালী, সেই পরীক্ষায় নামে।

স্থানীয় ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদের সদস্য তাজুল ইসলাম বাবলু জানান, গুটি খেলায় এবার করোনার প্রভাব পড়েছে। স্থানীয় প্রশাসন গুটি খেলার আয়োজকদের ডেকে এবারের গুটি খেলা নিষেধ করেছিল। খেলার মাঠে মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত পুলিশ। গুটি খেলা ফুলবাড়িয়া উপজেলার একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খেলা। ২৬২ বছর ধরেঐতিহ্যবাহী গুটি খেলা এখনো ধরে রেখেছেন গ্রামের মানুষ। প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে এবার গুটি খেলা শুরুতে খেলোয়াড়ের উপস্থিতি তুলনামূলক কম হলেও সন্ধ্যা থেকে আসতে শুরু করেন খেলোয়াড়েরা।

‘হুমগুটি’ খেলায় সন্ধ্যা হাজারো খেলোয়াড়ের ঢল
ছবি: লেখক

এক মণ ওজনের পিতলের গুটি নিয়ে টানাহেঁচড়া–ধাক্কাধাক্কি সবই হয় এ খেলায়। তবে হয় না কেবল কোনো সংঘর্ষ।
ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশরাফুল ছিদ্দিক জানান, গুটি খেলার আয়োজকদের ডেকে এবারের খেলা করোনার কারণে বারণ করা হয়েছিল। আয়োজকরা আমাদের কথা শুনেছেন, তাই অনানুষ্ঠানিকভাবেই এবারের গুটি মাঠে গড়িয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে খেলা শুরু হয়। রাত সাড়ে ১০টায় খবর আসে হুমগুটিটি দেওখলা ইউনিয়নের কালিবাজাইল গ্রামের আবদুল কাদের বাড়িতে পাওয়া গেছে। দেওখলা ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল হদী বলেন, ‘খেলায় আমাদের ইউনিয়নের পালোয়ানেরা হুমগুটি ছিনিয়ে আনেন। এ জন্য আমি খুব আনন্দিত। এমন সাহসী মানুষের পাশে থাকতে পেরে খুব ভালো লাগছে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, বর্তমান সময়ে মাদকের ভয়াল থাবা যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, কমে যাচ্ছে মাঠ। বিনোদনের কসরতগুলো হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের অস্তিত্ব থেকে। তাই শুধু ফুলবাড়িয়া না, এই হুমগুটি খোলার মতো আরও অনেক ঐতিহ্যবাহী খেলা আছে, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিখ্যাত। সেসব খেলা সদর্পে টিকিয়ে রাখতে সামাজিক সংগঠনের পাশাপাশি সরকারেরও উদ্যোগ নেওয়া উচিত।