মানিব্যাগ

প্রচণ্ড রোদ। বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। কপালে বাঁ হাত রেখে সূর্যকে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। দেখতে পাচ্ছি না। কপালপোড়া রোদ।

একটু পরপর দূরপাল্লার বাস আসছে। বাতাসের ঝাপটার সঙ্গে ধুলাবালুর ঝাপটাও  চোখেমুখে লাগছে। চশমার কাচে ধুলাবালুর প্রচণ্ড ভিড় লেগে যাচ্ছে। একজনের ওপর আরেকজন। তার ওপর আরেকজন। ধুলাবালুর কারণে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। চশমাটা চোখ থেকে খুলে পরিষ্কার করতেও ইচ্ছা করছে না। জমুক ধুলাবালু। তারা জমতে জমতে যখন ক্লান্ত হয়ে যাবে, তখন তাদের আবার রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেব।

বারবার বলতে ইচ্ছা করছে কবি ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?’ মনে মনে বললাম, বাস পাওয়ার কত দেরি, পাঞ্জেরী!

এই বাক্যটি বলার পরপরই কাকতালীয়ভাবে বাস এসে দাঁড়াল। বাসে চড়ার আগে হেলপারকে বললাম, ‘বাসে সিট আছে?’

‘কী কন, মামা? বাসে সিট থাকবে না মানে? ওঠেন মামা, ওঠেন মামা। চালু মামা, চালু।’
বাসে চড়ে দাঁড়িয়ে আছি। বাসের সব সিট আছে ঠিকই কিন্তু যাত্রীদের দখলে। একটা সিটও খালি নেই। সব বুকড।

‘কী মামা, তুমি মিথ্যা বললে কেন? বাসে তে একটা সিটও নাই?’
হেলপার টাকা গুনতে গুনতে বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসল। বত্রিশটা দাঁতের বেশিও হতে পারে। গুনে দেখার দরকার ছিল। সে হেসে বলল, ‘আমি তো মিছে কতা কই নাই। আপনে জিগাইছেন বাসের সিট আছে কি না। আমি বললাম, হ আছে৷ ওঠেন মামা, ওঠেন। চালু মামা, চালু। এহানে আমার তো কোনো দোষ নাই।’
‘ও আচ্ছা, সেই কথা। ভাড়াটা তুমি কীভাবে নিবে, দেখা যাবে।’

‘মামা, কী যে বলেন না।’
‘ধুত্তেরি, তোর মামার গুষ্টি কিলাই। ভাই ডাকো, ভাই।’
পাশের সিটের এক ভদ্রলোক জানালার পাশে বসতে দিল। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম। এখনো পৃথিবীতে ভালো মানুষ আছে দেখছি।
‘ধন্যবাদ ভাই!’

‘ধন্যবাদ দেওয়ার দরকার নাই। এটা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য।’
সে হাসল৷ আমিও হাসলাম। কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে হাসাহাসি হলো।
হেলপারের গলার সুর বেশি একটা জুতের না। তারপরও সুরের ওপর চাপাচাপি করে গান গাচ্ছে। শুনতে অবশ্য মন্দ লাগছে না। ওর গানের সুরের ঠেলায় আমি বারবার দূরে ছিটকে পড়ছি। কী ভয়ংকর! কী জঘন্য!

‘ওস্তাদ, ডানে প্লাস্টিক। বামে বেইমান। দ্যাইখে-শুইনে যান। এই প্লাস্টিকের বাচ্চা প্লাস্টিক, মরতে চাস? উপরে উডাইয়া দিমু কিন্তু।’ আমি হেলপারের কর্মকাণ্ড দেখছি৷ প্লাস্টিকের অর্থ বুঝলাম কিন্তু বেইমানের অর্থ বুঝলাম না। যাহ্, সবকিছু বোঝার দরকারও নেই।

জানালার পাশে মাথা রেখে ঘুমাতে চেষ্টা করছি। চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দেখতে অবশ্য মন্দ লাগছে না। জানালার কাচে তাকালেই নিজেকে দেখতে পারব। কিন্তু এখন আর দেখতে ইচ্ছা করছে না। ঘুম চোখের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। হঠাৎ এসে পড়বে।

সুতরাং এদিক-সেদিক তাকিয়ে আরামের ঘুমটা নষ্ট করা হয়তো ঠিক হবে না।
পাশের ভদ্রলোকটি বারবার পায়জামার পকেটে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। করুক। ইচ্ছা করলেই তাকে হাতেনাতে ধরতে পারব। ঘুম চোখে এসে গেছে। পায়জামার পকেট থেকে লোকটা মানিব্যাগ বের করছে। খুব ধীরে ধীরে। আমি দিব্যি বুঝতে পারছি। ধরতে ইচ্ছা করছে না। বড্ড মায়া হয়ে হচ্ছে তার জন্য। এভাবে ধরে ফেললে বেচারার অবস্থা কেরোসিন হবে। থাক, আজ শান্তিমতো চুরি করুক। কী আর নেবে, শুধু মানিব্যাগই তো!

অবশেষে বেচারা কাজটা সমাধা করে ফেলেছে। একটু পর আমার কাঁধে মৃদু স্পর্শ করে বলল, ‘ভাইজান, ঘুমাইয়া গেছেননি?’

আমি চোখমুখ টান টান করে বড় একটা হাই তুলে আবার ঘুমের ভান ধরলাম।
‘ভাইজান, চলে যাইতেছিগে!’

শরীরের আড়মোড়া ভাঙার অভিনয় করতে লাগলাম। যাক, বেচারা চোর হলেও এতটুকু ভদ্রতা আছে। সৌজন্যের খাতিরে বলে যাচ্ছে যাওয়ার আগে।
‘কষ্ট দিয়ে গেলাম, ভাইজান।’

‘আরে নাহ্, কী যে বলেন না। উল্টো আমি আরও কষ্ট দিলাম। আপনার সময় একটু বেশে লেগে গেল।’

বেচারার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বিড়ালের মতো এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে।
‘জি, কিছু বললেন?’

আমি আবার ঘুমের ভান ধরে জানালার পাশে ফিরতে ফিরতে বললাম, ‘জি না, দ্রুত নামুন। সবাই নেমে যাচ্ছে।’

ভদ্রলোকটি রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যাই, হ্যাঁ?’

বাস চলতে শুরু করল। আমি হাত নেড়ে বললাম, ‘পকেটটা মেরে দিয়ে গেলেন ভাই।’
সে হাসল। তার হাসির অর্থ করলে হবে এ রকম, ‘ভাইজান, এটাই আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য।’