‘উপড়ে ফেলার মতো চুল কই আমার?’

ধর্ষণ
প্রতীকী

আমি সাহিত্যিক নই, শিক্ষার্থী। কিন্তু কখনো কখনো কোনো ঘটনা বিবেককে এত নাড়া দিয়ে যায় যে মনে পড়ে যায়, আমার হাত নিশপিশ করছে মাথার চুল ছেঁড়ার জন্য, কিন্তু হায়! মাথার চুল কোথায়!

সত্যিই তো! পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজব্যবস্থায় আমার উপড়ে ফেলার মতো চুল কোথায়! বরং সে পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই তো আমি–সমেত আমার নিশপিশে হাতকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। যদি আমি শহুরে মেয়ে হই, তবে ‘মেয়ের পোশাক দ্যাখো, এই মেয়ে আজকালকার যুগে একা চলার সাহস করে কীভাবে! ঠিকই আছে আধুনিক হলে তো এমন হবেই!’ যদি গ্রামে থাকি, তবে ‘মেয়ের পরিবারকে টাকা দিতে হবে, মেয়ে সামলে রাখতে পারো না? নয়তো মেয়ের মাথা মুড়ো করে গ্রামে ঘোরাব!’

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এখনো ধর্ষণের বা হেনস্তার শিকারকে ‘নষ্ট মেয়ে’ তকমা দেওয়া হয়। একুশ শতকে এসেও একটা মেয়েকে কেন শুধু তার শারীরিক একটা অঙ্গ দিয়ে বিচার করা হবে? তার যোগ্যতাকে কেন এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হবে?

বেশির ভাগ মেয়েই তাই মানসম্মান, বিয়ে, সমাজ—এসব ভেবে চুপ করতে শিখে মান। শিশুকালে আদরের ছলে স্পর্শকাতর স্পর্শ, রাস্তাঘাটে চলতে–ফিরতে একটু-আধটু ছুঁয়ে দেওয়ার ‘দুষ্টুমি’, মেলা বা লোকসমাগমপূর্ণ স্থানে ‘ওই একটু–আধটু হয়ই’, বাড়িতে বা প্রতিবেশীদের দ্বারা ‘তেমন কিছু না তো’—এসব নিয়েই মেয়েদের চলতে হয়। কেউ কেউ মেনে নিতে পারে না বলে হয়তো প্রতিবাদ করেন, কখনো সুবিচার পান, যার হার খুবই নগণ্য। আর কখনো, ‘জানিস, অমুক মেয়ের এই হইছে’। বলাই বাহুল্য, অমুক মেয়ের কাহিনি আড়ালে অপরাধী পুরুষটি এমনভাবে চলতে পারে, তার কিছু হয় না, কারণ পুরুষ মানেই শক্তিশালী, অবলা নারী তার কী করার আছে? প্রভাবশালী বলে কখনো বিচারের বাইরে থাকেন। মুখে আলাদা কাপড় বেঁধে লুকিয়ে চলতে হয় সেই অমুক মেয়েটিকে।

আচ্ছা, দিনাজপুরে পাঁচ বছর বয়সী শিশুর যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে যখন তাকে ধর্ষণ করা হয়, শিশুটির কী দোষ ছিল? তার দোষটা কি এই পৃথিবীতে মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া? তিন বছর বয়সী শিশুটি যখন প্রতিবেশী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়ে রক্তক্ষরণে হাসপাতালে ভর্তি হয়, একবার ও কি আমরা অনুভব করেছি তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ? সে তো শিশু, হয়তো আধো আধো বোলে বাংলা বলে ঠিকমতো কথাই শেখেনি। বাকি জীবনে সে কি আর কোনো পুরুষকে শ্রদ্ধা করতে পারবে? কিংবা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে শহরগামী কোনো মেয়ে দীর্ঘদিন পর বাড়িতে ফিরবে। মাকে হয়তো ফোন দিয়ে তার পছন্দের খাবার রাঁধতে বলেছে। ছোট ভাইবোনদের জন্য কিনে নিয়ে যাচ্ছে উপহার। ভেবে দেখুন তো, চলন্ত বাসে তাকে যদি ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়, তার জায়গায় আপনার বা আমার বোনকে কল্পনা করা হয়, অন্তরাত্মা কীভাবে কেঁপে উঠবে?

তবু আমরা এসব এড়িয়ে চলতে শিখেছি। দুই দিন পর পর কোনো খবর আমাদের চোখে পড়ল, যে যার মতো শেয়ার করলাম, আলোচনা চলল। নতুন কোনো ‘হট ইস্যু’ এলে আমরা আগেরটাকে ছুড়ে ফেলি। কেনইবা ফেলব না, আমাদের সঙ্গে তো আর হয়নি, একটু–আধটু ওসব হয়ই। এসব তো আইন-আদালত দেখবে?

আসলেই কি সম্ভব? একবার সেই মেয়ে বা তার পরিবারের সদস্য হিসেবে কল্পনা করে দেখুন তো আদৌ কি চুপ থাকা যায়? কবে সুদিন আসবে? মানুষের মনুষ্যত্ববোধ লোপ পাবে না। শান্তির পৃথিবীতে আমরা প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারব?

  • লেখক: নাফিসা তাসনিম বিনতে খলিল, এইচএসসি পরীক্ষার্থী, কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট স্যাপার কলেজ, নাটোর।