আমাদের আব্বা অতি সাধারণ

আব্বাকে হারিয়েছি পাঁচ বছর। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে অন্যদের ভুগিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়নি। তাঁর চলে যাওয়া ছিল আকস্মিক। এক দিনের অসুস্থতায় শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি হন। আমি সকালে তাঁর কেবিনে যাই, জ্ঞান ছিল। বিছানায় শোয়া, কথা বললেন। আমাকে দেখে বললেন, চশমাটা নিয়ে আসিস। কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

আমার সঙ্গে এই শেষ কথা।

আমি দুপুরে বাসায় যাই। চশমা নিয়ে আসি। সঙ্গে আম্মাকে আনি। বেলা তিনটার দিকে তাঁর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। ৭৬ বছরের শরীর তা সামলাতে পারেনি। হাসপাতালের নিচে যখন পৌঁছাই, তখন ভাইয়ার ফোন। ভাইয়া শুধু বললেন, আম্মাকে নিচে বসতে বল। তুই আইসিইউতে আয়।
চশমা হাতে আইসিইউতে ঢুকি। কিন্তু আব্বা তখন এসবের ঊর্ধ্বে। চাদর তুলি। আব্বা নিথর। শান্ত। মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছেন। শুধু অনন্তলোকে তাঁর রুহু।

‘আমরা তো আল্লাহরই। আর নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।’ আমি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল এ বিশ্বাসে। জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে গত বছরগুলোয়। বড় চাচা চলে গেছেন। দ্বিতীয় মাতাসম খালাম্মিকে হারিয়েছি। বেশ কজন প্রিয় মানুষের মৃত্যু দেখতে হয়েছে, যার প্রতিটি ক্ষণে আব্বাকে মিস করেছি। আব্বার বাধ্য ছেলে হলে জীবনে ভুল কম হতো। আবার ভাবি, জীবন তো শুরু। এখন তাহলে আব্বার কথাগুলো মনে রাখি। কিন্তু মানুষটাকে তো আর পাব না।

কোনো ধনাঢ্য পূর্বপুরুষ আমার আব্বা মো. আবদুল হকের চোখে পড়েনি। তাঁর ধারণা, খুলনার কোনো এক তালুকদার বরিশালের বাকেরগঞ্জের বাহাদুরপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। সেই থেকে পরম্পরা। আমার দাদা কৃষক আবদুল হাকিম তালুকদার। কোনো তালুক ছিল না তাঁর। জমি যা ছিল, বেশির ভাগই ‘বান্ধা’। বড় চাচাও পেশায় কৃষক। এরপরের মেজ ছেলে আব্বা। বাকেরগঞ্জের ‘মেজ বাই’। সেজ চাচা এরপর। পরে ছোট চাচা আর ফুফু।

দাদা চাইতেন তাঁর খেতের সঙ্গী। বড় চাচার সঙ্গে আব্বা এসে যেন যোগ দেন। আব্বা বললেন, পড়ব। ম্যাট্রিকুলেশন পার করলেন। বিএম কলেজে ভর্তি হলেন। দাদা বললেন, ‘বাবা, আর তো পারি না!’ আব্বা বললেন, ‘দরকার নাই। আমি বরিশালে লজিং থাকব।’

বিকেল থেকে বাসার বাচ্চাদের পড়াতেন আর বিনা মূল্যে খাওয়া-ঘুমের ব্যবস্থা। এরপর সকাল হলেই বিএম কলেজের দিকে পথ হাঁটা। কিন্তু তাঁর সেই বরিশালের পথটি লুপ্ত কিন্তু মর্মময়। এক ঈদের চানরাতে বরিশাল শহরে রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে আব্বা আমাকে দেখিয়েছিলেন কয়েক দশক আগে জীবনানন্দ দাশের অদৃশ্য পথের ছাপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ৬০-এর নগরে বাসায় বাসায় টিউশনি করেন। দ্রুত পরিবারকে দাঁড় করানোর জোয়াল। ছোট দুই ভাইকে নিয়ে পল্টনের দিকে মেসে থাকা শুরু। রাজধানীতে নিজের দাঁড়ানোর লড়াইয়ের সঙ্গে ছোট ভাইদের যুক্ত করেন। রব চাচা আর সেলিম চাচার পড়াশোনাসহ সব দায়িত্ব আব্বা নিয়ে চলেছেন বহু আগে থেকে।
আব্বা দেখতেন রেসকোর্স, পথে ময়দান। বাংলাদেশ সৃষ্টির পুরো প্রক্রিয়া দেখছেন আসা-যাওয়ার মধ্যে। কিন্তু মিছিলে যেতেন না। তিনি বহু দেখেছেন মিছিলে গুলির দৃশ্য। দাদা লাশ সইতে পারবেন না বুঝে। আর দাদি সোনা বড়ু? আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাদুর নাম কী? ‘খালারা তো শুনতাম সনু, সনু বলে ডাকত’—আব্বার জবাব। আব্বার ছোটবেলা নিয়ে দাদি আমাদের বলেছেন, ‘চান্দের গায়ে ময়লা আছে, আমার আবদুল হকের গায়ে কোনো ময়লা নাই।’

অসাধারণত্ব ছিল আব্বার ঢাকা থাকার সময়টায়। চারপাশে বেড়ে উঠছে জাতিরাষ্ট্র গঠনের ভ্রূণ। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে। পল্টনে বহু দিন হাঁটতে দেখে সালাম দিয়ে রিকশা ডেকে দিতে চেয়েছেন। রাজ্জাক স্যার রিকশায় চড়তেন কম। হাঁটতে পছন্দ করতেন। রাজ্জাক স্যারের ক্লাস লেকচার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকেরা বলতেন, ‘স্যারের কথা তো আমরাই বুঝি না। তোমরা কীভাবে বুঝবে!’ এ কথাও ‘যদ্যপি আমার গুরু’ পড়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি।

এমএ শেষ করে আব্বা ফিরলেন বাকেরগঞ্জ। বাহাদুরপুর গ্রামের দ্বিতীয় গ্র্যাজুয়েট আমার আব্বা। বাড়ির পাশে বোয়ালিয়া প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। মাস যায়, বেতন নেই। এর মধ্যে অনেক আগে অ্যাপ্লাই করে রাখা পাকিস্তান অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগের অডিটর পদের চাকরির ডাক। থাকার ব্যবস্থা আছে। স্টাফ বাস আছে। আব্বা দ্বিতীয় চিন্তা করার অবস্থায় ছিলেন না। দাদার বয়স বাড়ছে। প্রমোশন ২০ বছর পরে হবে জেনেও সেই পদেই আব্বার যোগ ১৯৬৫-তে।

সেজ চাচা উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। ছোট চাচা স্কুলে। তিন ভাই মিলে কোয়ার্টার না পাওয়া পর্যন্ত সময়টায় থাকলেন পল্টনের মেসে।
মাসের ১ তারিখে দাদাকে মানিঅর্ডার করতেন। ভাইদের পড়াশোনাসহ যাবতীয় দায়িত্ব অডিটর আমার আব্বার বেতনে। আইনে পড়ার ঝোঁক ছিল। কিন্তু পেশা বদলের ঝুঁকি নেওয়ার দশা ছিল না। পরিবার আর এজি অফিস—এই যৌথ জোয়াল টানা মানুষ আমার আব্বা।

আমার আব্বা একাত্তরের মে পর্যন্ত ছিলেন চাকরিরত। ঢাকার পথে একবার পাকিস্তানি মিলিটারি ধরে তাঁকে। তিনি ‘ড্যান্ডি কার্ড’ দেখান। তবু তাঁকে ট্রাকে তোলা হয়। একটু পর এক উত্তেজিত অফিসার আসেন। অধস্তনরা আব্বার পরিচয় বলেন। অফিসার আমার আব্বার পিঠে লাথি মেরে ট্রাক থেকে ফেলে দেন। লাথির সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি মিলিটারি অফিসার আব্বাকে বলেন, ‘ভাগ, যা ইহাসে বাঙ্গাললোক...।’ আমার আব্বা পাকিস্তানি মিলিটারির বুটের লাথি খাওয়া লোক। যে কেউ তাকে পিষে মারলেও টুঁ নেই এমন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামে ফেরায় দাদা-দাদি খুব খুশি হন। বাহাদুরপুরবাসী ঢাকার খবর জানতে ভিড় করে ‘মেজ বাইয়ের ধারে’। আব্বা শহরের রাস্তায় রাস্তায় বুলেটে নিহত মানুষ আর পোড়া শহরের দৃশ্য তুলে ধরেন। চেপে যান একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে পরিচয়পত্র দেখানোর পরও পাকিস্তানি আর্মির বুটের লাথি খাওয়ার অভিজ্ঞতা।
দাদাবাড়িতে বহু মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু আমার আব্বা নিজে মেজর জলিলের স্কোয়াডে নাম লেখানোতে সাহসহীন। রেডিও শুনতেন নিয়মিত। ডায়েরিতে নোটও লিখতেন। রেডিও থেকে শুনে দিনের একটা সংক্ষিপ্ত নোট লিখতেন।

একাত্তরের ২৫ ও ২৬ মার্চ আব্বার ডায়েরিতে পাই:
২৫ মার্চ ১৯৭১
Both Mr. Bhutto & gen. yahia left Dacca for Karachi in evening flight. On this day night the Army captured the entire Dacca city and started heavy firing upon innocent people.
২৬ মার্চ ১৯৭১
Gen.Yahia delivered speech to the Nation at 8 am. In his speech he banned awami league as a political party and banned political activities in E.B.
He ordered army to contain their activity in full swing.

বিজয়ের পর ঢাকায় ফেরা। কর্মস্থলে যোগ। আজিমপুর কলোনিতে ছোট দুই ভাইকে নিয়ে আব্বার সংসার। ১৯৭৫-এ আশ্রয় হয় মিরপুরে এক ছোট্ট রুমের কলোনিতে। স্টাফ বাসে মিরপুর থেকে ‘ঢাকা’য় অফিসে যেতেন। মিরপুর এতই দূরে তখন।
দাদা তখন অনেকটা নির্ভার। বয়স হয়ে যাচ্ছে। ছেলের বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত।

১৯৭৭-এ বিয়ে ঠিক হলো বরিশালের রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের বারোঘরিয়া শিকদারবাড়ির ছোট মেয়ে রাশিদা বেগমের সঙ্গে। সেজ খালা স্থায়ী বরিশালের বগুড়া রোডের বাড়িতে। হাসিনা খালাম্মি খালুর সঙ্গে বাগদাদে। বড় খালাম্মি ছিলেন মাতৃহীন সবশেষ ছোট বোন আম্মার খুঁটি হয়ে। তিনি স্থায়ী ঢাকার শাহজাহানপুরের বাড়িতে। আম্মার মিরপুরের কলোনি পছন্দ হলো না। সদ্য বিবাহিত সংসার তখন দুই ছোট চাচা সমন্বিত। আব্বা শুধু বললেন, ‘ধৈর্য ধরো। আমাদের এমন দিন থাকবে না।’

আমার মনে হয় আব্বার আজিমপুর কলোনিতে না গিয়ে মিরপুরের এ ছোট্ট কলোনি ঘরে থাকার সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। নাগরিকতার বাইরে মাঠের পর মাঠ, সঙ্গে অপরূপ বিল-ঝিল-নদ তুরাগের মিরপুর আমরা পেয়েছি। বাসার কাছেই বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, মিরপুর স্টেডিয়াম।
একই দশকে ঘটে আরেকটি ঘটনা। সব খালা চলে এলেন ছোট বোনটির পাশে, আমাদের মিরপুরে। আনন্দসমুদ্রের শৈশব আমাদের। কলোনির দোতলায় মেজ খালা। তিনতলায় আরেক খালাম্মি। সব কাজিন মিললেই ফুটবল টিম হয়ে যায়।

নব্বইয়ের দিকে আব্বাকে অ্যাকাউন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সদ্য গঠিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। আমি ১৯৯৬ সালে প্রথম সচিবালয়ে গেছি আব্বার সঙ্গে। কেক-পেস্ট্রি শপে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। আব্বার রুম থেকে দেখলাম নূর হোসেন চত্বরের পুরোটা। খুব এনজয় করেছেন চাকরির এ সময়টায়। চাকরির শেষ জীবনে সুপারিনটেনডেন্ট পদে প্রমোশন পেয়েছেন। কিন্তু বেতন একই।

আমৃত্যু আব্বার সংসারে খবরের কাগজ রাখা হতো। অনেক ছোটবেলায়ও বইমেলায় বই কেনার বাজেট থাকত। একাডেমি থেকে বেরিয়ে হাত ধরে ঘুরে ঘুরে ছোটবেলায় আমাদের তাঁর ক্যাম্পাস দেখাতেন। মধুর ক্যানটিনে আমি প্রথম গেছি ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়, আব্বার হাত ধরে। আমাদের বিত্ত কোনোকালেই ছিল না। যৌথ পরিবার। আব্বা একক অর্থের জোগানদাতা। ছোটবেলার এক ঈদে আব্বাকে রিপু করা পুরোনো পাঞ্জাবি পরতে দেখেছি। আমার আব্বা সাধারণ। অতি সাধারণ।

আব্বার মৃত্যুর পর পেনশন-সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ কবার এজি অফিসে যাই। সেখানে আব্বার সহকর্মীরা বলতেন, ‘স্যার ছিলেন সিরাতুল মোস্তাকিম।’ সরকারি অফিসে কোনো ভোগান্তি পাইনি। সব আনুষ্ঠানিকতা তাঁর সহকর্মীরা করেছেন দ্রুততম সময়ে।
বরিশালের এই অতি সাধারণ আমার আব্বা এখন মিশে গেছেন মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের মাটিতে। তাঁর ইচ্ছা ছিল এমন। স্থায়ী কবর না রাখার বিষয়ে তাঁর নিজের কিছু যুক্তি ছিল।
Tears In Heaven গানে Eric Clapton বলেছেন,
‘Would you know my name
If I saw you in heaven?
Would it be the same
If I saw you in heaven?’

এ প্রশ্ন নিয়মিতই মাথায় ঘুরপাক খায়। হয়তো মাত্র এক নিশ্বাস দূরের অনন্ত জীবনে আমরা সবাই মিলিত হব। এর আগ পর্যন্ত আমার অতি সাধারণ আব্বাকে জড়িয়ে ধরার অপেক্ষা।