অবুঝ মেয়ে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শ্রাবণ মাস। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।
ঘুম-ঘুম ফোলা মুখে ছয়–সাত বছরের একটা মেয়ে জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মায়াকাড়া চেহারা। বড় বড় চোখ। দীর্ঘ আঁখি পল্লব। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। গায়ের রং স্ফটিকের মতো সাদা।

উঠানে বাবার লাশ। জানাজার খাটে শুয়ে আছেন। জানালা পথে হাত বাড়িয়ে বাবাকে বারবার ডাকছে। বাবা সাড়া দিচ্ছে না তার ডাকে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। বাবা বৃষ্টিতে শুয়ে শুয়ে ভিজছেন। বাবার সঙ্গে তারও ভিজতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কেউ তাকে উঠানে বাবার কাছে যেতে দিচ্ছে না। সবাই তাকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সবার চোখ বেয়ে জল পড়ছে টপটপ করে।

লাশের প্রতীকী ছবি

মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি আব্বুর কাছে যাব। আব্বুর সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজব।’
যেন কেউ তার কথা শুনতে পাচ্ছে না। তার কান্না দেখে কারও কারও কান্নার শব্দ আরও বেড়ে গেল। তার বুঝে আসছে না,এ বাড়িতে এত কান্নার আয়োজন হচ্ছে কেন? আগে তো কখনো এমনটা হয়নি। কয়েক দিন আগে জন্মদিন গেল। এরাই এসেছিল। কিন্তু তখন তো এরা কাঁদেনি। সবাই হেসেছে। হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ের ওপর গড়িয়ে পড়েছে। দিনটা কী সুন্দর ছিল!

মৃত্যু কী জিনিস, মেয়েটি জানে না। জানবার কথাও না। এ বাড়িতে শুধু তার মা–বাবা থাকেন। দাদা-দাদি তার জন্মের আগেই মারা গেছেন। কখনো দেখেনি সে তাদেরকে।
আজ বাবাকে দেখছে। সাদা জামা পরে জানাজার খাটে শুয়ে আছেন। চোখ বুজে।
বাবা মাঝেমধ্যে এভাবেই ঘুমিয়ে থাকেন। ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলেন। অদ্ভুত আওয়াজ করেন। মা ঘর কাঁপিয়ে হাসেন আবার খানিক বিরক্তও হন। বাবার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেন। বাবার আওয়াজ তখন আর শোনা যায় না। সে আর মা গল্প করে, রাজ্যের গল্প,পরিদের দেশের গল্প, সব গল্পই তার বাবাকে ঘিরে। মা গল্পের ফাঁকে বলেন, ‘তুমিও কিন্তু পরির মতো সুন্দরী। তোমার মতো আমিও পরি ছিলাম। পরিদের সরদারের মেয়ে ছিলাম। আমার দু-দুটি ডানা ছিল, ডানা ঝাপটে আসমানে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াতাম।

একদিন হয়েছে কি, তোমার বাপজান আমারে দেখে ফেলল। তারপর তোমার নানাজির কাছে গিয়ে বলল, আপনের মেয়েকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি শাদি করে ফুলের মতো একটা সংসার সাজাতে চাই। ‘ও’ সারা দিন ফুলদের সঙ্গে খেলা করবে। আমি বসে বসে শুধু ওর খেলা দেখব!

মেয়েটি তার মায়ের গল্প শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ত, বলতেই পারত না। ঘুম থেকে জেগে উঠে মনে হতো, ইশ, গল্পটা আজও অসম্পূর্ণ থেকে গেল!

উঠানে বাবা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আচ্ছা, বাবার নাকে তুলা গুঁজে কে দিয়েছে? হয়তো আম্মুই দিয়েছেন। আম্মু ছাড়া এ কাজ করার সাহস কারও নেই।
বাবার জানাজার খাট চাচা, জেঠারা কাঁধে নিলেন। সবাই দোয়া পড়ছেন। মা দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। সে তার মায়ের ঘোমটা টেনে অনেক কথা বলছে।
আব্বুকে আজ ভীষণ মনে পড়ছে মেয়েটির।

প্রতিদিনের মতো আজও বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে চায়, বাবার ঠোঁটে আদর এঁকে দিতে চায়। কিন্তু কেউ তাকে বাবার কাছে নিয়ে যায় না। যখনই বাবার কথা মনে পড়ে, তার মা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল টপটপ করে ফেলে। জল ফেলতে ফেলতে বলে, ‘তোমার বাবজান মাওলার সঙ্গে সাক্ষাতে গেছেন। যাওয়ার আগে বলে গেছেন—তুমি, আমি আর তোমার পিচ্চি ভাইটিকে যেন নিয়ে যাই সেখানে। খুব শিগগির আমাদের দেখা হবে!’

‘কাঁদে না মামণি, কাঁদে না।
তুমি কাঁদলে বাবার খারাপ লাগবে না বুঝি!’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

মেয়েটি মায়ের বুকে শান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। মা অঝোরে কাঁদতেই থাকেন। কাঁদতে কাঁদতে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেন। চোখের জল শাড়ির আঁচল দিয়ে যতই মোছেন, ততই ঝরনার মতো ধীরে ধীরে নামতেই থাকে। এ জল একদিন শুকিয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু নদীর নালার মতো আজীবন তাঁর চেহারায় থেকে যাবে!
লেখক: মনজুর সা’দ, কসবা, শেরপুর