অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষার বাস্তবতা কতটুকু

করোনা সংক্রমণ না কমায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। এইচএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষাও বাতিল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন করা হবে। সাত মাস ধরে পরীক্ষার্থীরা এ পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত ছিল। অবশেষে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তে তারা অনেকটাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু এই চিন্তার অবসান হলেও পরীক্ষার্থীদের সামনে ভর্তি পরীক্ষা নামক আরেক যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে।

করোনা মহামারিতে কীভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে—এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) উপাচার্যদের নিয়ে অনলাইন সভার আয়োজন করে। যেখানে নানা আলোচনার পর অনলাইনে চলতি বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় উপাচার্যদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ।

অধিকাংশ উপাচার্যদের পরামর্শের ভিত্তিতে পরীক্ষায় ব্যবহার করা হতে পারে অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূরের তৈরি একটি বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রক্টর রিমোট এক্সাম সিস্টেম (প্রোকয়াস)’। করোনা মহামারির এই সময়ে বিগত বছগুলোর মতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পরীক্ষা নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, এটা যেমন সত্য, তেমনি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে, অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা কতটুকু বাস্তবসম্মত, সে বিষয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায়, এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সব পর্যায়ে অনলাইন ক্লাস চলমান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম দিকে অনলাইন ক্লাসে অনীহা থাকলেও পরবর্তী সময়ে সব বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়। অসচ্ছলতা, দরিদ্রতা, নেটওয়ার্কের দুর্বলতা, বিদ্যুৎ সমস্যা এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সরকার অসহায় শিক্ষার্থীদের জন্য অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস ও নামমাত্র মূল্যে ইন্টারনেট সেবার ব্যবস্থা করে।

এত কিছুর পরেও বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের হার কামলেও গ্রামাঞ্চলে এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা নানা জটিলতায় অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিলে শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হবে না, এমনটা না ভাবার অবকাশ নেই। প্রযুক্তিগত জটিলতার কারণে যদি কোনো শিক্ষার্থী বঞ্চিত হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।

উপাচার্যদের মতে, উন্নত দেশগুলোয় অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা ছাড়া দেশে অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা এই প্রথম। যদি বিগত বছরে অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার অভিজ্ঞতা থাকত, তাহলে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার সীমাবদ্ধতাগুলো বেরিয়ে আসত। ফলস্বরূপ প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হতো। এ জন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের জন্য এটা একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

দেশের বেশির ভাগ পরীক্ষার্থী গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে আসে। গত বছর কৃষি বিষয় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। চলতি বছর বুয়েট এবং চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) নিজেদের মতো করে আলাদাভাবে পরীক্ষা নেবে। বাকি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তিনটি গুচ্ছ করে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবছে ইউজিসি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে একটি, সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি এবং প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আরেকটি গুচ্ছ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদি এভাবে গুচ্ছ আকারে পরীক্ষা নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীদের বিগত বছরের মতো একাধিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এইচএসসির ফলাফল প্রকাশ করা হবে, এমনটাই জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চলমান থাকলেও অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা ও অনার্স চতুর্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা এখনো নেওয়া হয়নি। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজটের আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রতিটি শিক্ষার্থী ও তাদের মা–বাবা, পরিবারের স্বপ্ন। ভর্তি পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মপরিকল্পনা। সাফল্যের সিঁড়িতে পা বাড়ানোর প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এটি।

করোনার এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা কঠিন। বিকল্প হিসেবে অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করার যৌক্তিকতা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের আরও ভাবা উচিত। তাই এই সময়টায় তাড়াহুড়া না করে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভৌত অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত দিক বিবেচনা করে আগানো বাঞ্ছনীয়।
*শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়