‘চলো সবে বই কিনি, আপনে আলো আনি’

ছবি: প্রথম আলো

বই আমাদের জ্ঞানের চোখ, যা মলাটে বদ্ধ থাকলে মনের ভেতর আলো প্রবেশ করে না। একটি বই একজন ব্যক্তিকে নিয়ে যায় জ্ঞানের অনন্য উচ্চতায়। জ্ঞানী ব্যক্তির কদর যুগে যুগে বাড়ে বৈ কমে না। জ্ঞানের ধাপে যে যত উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবে, সে ততই মহৎ প্রাণের অধিকারী হয় এবং জগৎজুড়ে খ্যাতি, সুনাম আর অমর থাকে স্বীয় কাজে। তাই জ্ঞানের বাহন বই ছাড়া মানবজাতির কল্যাণ ও উন্নতি আর কোথাও নিহিত নেই। বর্তমানে একজন খেটে খাওয়া মানুষও রোজ দুটি পয়সা যদি রোজগার করেন, সবার আগে তাঁর সন্তানকে স্কুলে পাঠান, বই, কলম আর খাতা কিনে দেন। বাস্তবিক পক্ষে বই ছাড়া মানুষের উন্নত জীবন গড়ার মানসিকতা তৈরি করা অসম্ভব। তাই তো পড়ালেখার গুরুত্ব কতটা, তা বোঝাতে সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন—‘তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেব।’ আর শিক্ষিত হতে হলে বই পড়ার বিকল্প নেই।

পেটের ক্ষুধা মেটাতে যেমন খাবার খাই, তেমনি মনেরও ক্ষুধা বা তৃষ্ণা থাকে। জানার আকাঙ্ক্ষা বিস্তৃত বিস্তর মনের। যদিও জ্ঞানের সাগরে দিনরাত এক করে হাজারো বই পড়লে বিন্দু পরিমাণ জ্ঞান অর্জন হয় মাত্র। হিমু চরিত্রের অনবদ্য স্রষ্টা প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, ‘একজন মানুষ তার সমগ্র জীবনে দশ হাজার বই পড়তে সক্ষম।’ এর বেশি বই পড়ার সময় ও সুযোগ মানুষের খুব কম হয়। এখন প্রশ্ন, অদ্যাবধি আমরা কয় হাজার বই পড়েছি?

হাতে গোনা ১০ বা ২০–এর বাইরে খুব কম মানুষই বই পড়েন। অথচ নিজেকে জ্ঞানী ভাবতে শুরু করে দিই। আর ভাবি পড়ালেখার সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছি কিনা পড়েই। ভেতরে একটা অহংবোধ চলে আসে।

কম পড়লেও পড়াকে এগিয়ে নিতে আমরা কেন যেন সচেষ্ট নই, যেমন ইলিশ মাছ খাওয়ার ব্যগ্রতা আমাদের তার চেয়েও প্রবল। চর্বি হলেও ক্ষতি নেই। খেতেই হবে। কিন্তু মনের খাবার জোগান দেবে কিসে, তা আমরা ভাবার সময় পাই না। আর এই অভাবকে গ্রাহ্যও করি না। তাই তো একটি বই শ খানেক টাকায় কিনে পড়ার মানসিকতা আজও আমাদের তৈরি হয়নি। মন বলে কিছু যে আছে, তা প্রেমে পড়লে, বিশ্বাসঘাতকের ছ্যাকা খেয়েই বোঝে মানুষ। কিন্তু বইয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করলে মন সবল থাকে। মানসিক দৃঢ় শক্তির জোগান দেয় বইয়ের প্রতিটি শব্দ। মানুষ মনে প্রবল বেগ পেলে হিমালয় ডিঙিয়ে যেতে সাহস করে। দুর্বল চিত্ত মাঝিবিহীন নৌকার মতো। আর এ থেকে মুক্তি পেতে বই পড়তে হবে। তাতে মনের প্রশান্তি বাড়বে আর বইকে ঘিরে স্বপ্ন বুনন চলবে। বই সুপথ দেখায়, পরিস্থিতি মোকাবিলায় শক্তি ও বুদ্ধির দুয়ার খুলে দেয়। চৌকস হতে শিক্ষা দেয় বইয়ের প্রতিটি পঙ্‌ক্তি।

ধরুন আপনার বন্ধুদের নিয়ে একটি চায়ের দোকানে বসলেন। খাওয়ার বিল দিলেন ৩০০ টাকা। তারপর সব বন্ধু আপনাকে ছেড়ে এক এক করে চলে গেল। আপনি সেই একাই রয়ে গেলেন। আফসোস করে বন্ধুদের যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করে মন খারাপ করছেন। আর জোর দিয়ে তাদের বলতেও পারছেন না আরেকটু বসতে। কারণ, সবারই পরিবার আছে, কাজকর্ম আছে। নীড়ে ফিরতেই হবে। কিন্তু সেই ৩০০ টাকা দিয়ে যদি আপনি একটি বই কিনতেন, তাহলে সেটা আপনার চিরস্থায়ী বন্ধু বনে যেত। সার্বক্ষণিক আপনি বইটি পাশে পেতেন। বইয়ের ভেতর প্রতিটি শব্দ আপনার আজীবনের বন্ধু হতো। সুখের কথা হলে হাসতেন আর দুঃখের কাহিনি হলে কেঁদে বুক ভাসিয়ে হালকা হয়ে যেতেন। আর জ্ঞানের আলোয় আপনি পূর্ণ হতেন, যা জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে সহায়তা করত।

নিয়মিত বই পড়া বারাক ওবামাকে নেতা হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে
ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাসের পাতা খুলতে বই লাগেই। অতীত জানতে, বর্তমান সাজাতে আর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বই একটি একক ও অনন্য সত্ত্বা। আমাদের পবিত্র কোরআন, বাইবেল, ত্রিপিটক সবই কিন্তু পবিত্র গ্রন্থ। প্রত্যেকে শুদ্ধ হতে ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ি এবং নিজেদের নিষ্পাপ রাখার চেষ্টা করি। তাহলে বইয়ের গুরত্ব মানুষের জীবনের শেষাবধি আছেই। যত বই পড়বেন ততই জীবন চলার পথ সুগম হবে, আমরা মানুষের চলা, বলা, মনের গতির আওয়াজ বুঝতে সক্ষম হব। মানুষ ওয়াজ মাহফিল করে, কঠিন চীবর দান, মুণিঋষির কথা শ্রবণ করে, দুর্গা আরাধনা করে ভালো কিছু বই ও তার সমন্বয়ক ব্যক্তির নিজের জ্ঞানমূলক কথা, বাণী শোনার জন্য। এতে মানুষ প্রশান্তি লাভ করে। আর বক্তা প্রচুর বই পড়ে, গবেষণালব্ধ জ্ঞান দিয়ে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন। তাই বই কিনে পড়াকে কখনোই ক্ষতি মনে করবেন না। একাগ্র চিত্তে বইকে বন্ধু করলে হলফ করে বলতে পারি, নিজেকে কখনোই আর একা বোধ করবেন না। অন্ধকার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে আপনার জন্য।

বর্তমানে তরুণেরা খুব সহজে মুঠোফোন সেটে যেভাবে আসক্ত, তাতে অধুনা বিশ্বে কী ভয়ানক খারাপ পরিবেশ ও চৌকসতার স্থবিরতার কালো অমানিশা নেমে আসছে, তা হয়তো আজ আমরা বুঝতে ও যথাযথ উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছি না। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এভাবে চলতে থাকলে এই উন্নত বিশ্ব একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে, সেদিন কিন্তু বেশি দূরে নয়। আর এসব থেকে একমাত্র মুক্তিদাতা বই। অবশ্যই একটি ভালো বই জীবনকে সমৃদ্ধ করবে, আলোকিত করবে। জীবনে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে একটি বাজেট রাখুন বই কিনতে, প্রিয়জনকে বই উপহার দিতে। বইমুখী করা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আপনার সন্তানকে হাতে মুঠোফোন না দিয়ে ভালো একটি বই দিন। তাকে উৎসাহিত করুন বই পড়তে। প্রয়োজনে আপনি নিজে সময় নিয়ে পরম স্নেহে সন্তানকে বসিয়ে বই পড়ে শোনান। অবশ্যই এ রকম পরিবেশ ঘরে তৈরি করলে বাবা–মাকে অবসরে বই হাতে দেখলে সন্তানেরাও বই হাতে নেবে। মানুষ অনুকরণপ্রিয়। উপদেশের চেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত হওয়া শ্রেয়।

সন্তানদের সারা দিন পড় পড় করলে তারা কখনোই পড়বে না। বই পড়ার মজাটা তাদের হাতে–কলমে বুঝিয়ে দিতে হবে। বই পড়ে মন আলোকিত করতে পারলে আমরা জীবনের লোভ, লালসা, ক্ষমতার লিপ্সা, অপরাধ করার মানসিকতা থেকে মুক্তি পাব। পৃথিবীতে ক্ষণিকের অস্থায়ী জীবনে লোলুপতা, ষড়রিপু থেকে মুক্তির পথ বই। আসুন আমরা বই কিনি, মন দিয়ে বইয়ের বার্তা পড়ি, মনে প্রশান্তি আনি। বই কিনে ঠকবেন না, বরং জিতে যাওয়ার কৌশল শিখবেন, ধৈর্য বাড়বে এবং দৃঢ় মনোবল পরাক্রম শক্তি জাগ্রত হবে।
‘চলো সবে বই কিনি,
আপনে আলো আনি।’

লেখক: পারভীন আকতার, শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম।

*নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]