এখনো হাতড়ে বেড়াই সেই স্মৃতি!

গরম–গরম ভাপা পিঠাছবি: কবির হোসেন

পূর্ব আকাশে সূর্য উঠেছে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকায় তা দেখা যায় না। বয়স চার কিংবা পাঁচ। ফজরে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে চলে যেতাম আমার বেড়ে ওঠা জন্মভূমি বাহাদুরপাড়া গ্রামের মসজিদে। নামাজ পড়ে সেখানে পড়তাম আরবি। পড়া না পারলে হুজুরের কাছে কান মলা, কান ধরে ওঠবস করা আবার বেতের বাড়ি খাওয়া। এখনো হাতড়ে বেড়াই শৈশবে হারিয়ে যাওয়া শীতকাল ও বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে মসজিদে যাওয়ার দিনগুলো। আহা, তখনকার দিনগুলো ছিল শ্রুতিমধুর, যা চাইলেও আর ফিরে পাব না। বারবার মন ফিরে পেতে চায় স্মৃতিপটে শৈশবের শীতকালে।

শৈশবের শীতকালের সময়গুলো ছিল অনেক আনন্দদায়ক। শৈশবে শীতকাল মানেই খুশির আমেজ। শীতকাল মানেই খেজুর রসের ঘ্রাণ এবং উনুনে জাল দেওয়া ভাপ ওঠা ভাপা পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যেত। আমাদের গ্রামে ভাপা পিঠা শীতকালে বাসায় গিয়ে গিয়ে বিক্রি করত। গাছিরা খেজুর রস মহল্লায় মহল্লায় নিয়ে যেতেন।

আমাদের গ্রাম থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে একই জেলার সালের হাট নামক জায়গায় শীতকালে চলে যেতাম নানির বাসায়। সেখানে খালা ও খালাতো ভাইবোনেরা সবাই একই দিনে জমায়েত হতাম নানির বাসায়। তখন সেখানে সবার আগমনে পরিণত হতো মিলনমেলা। সবার কত দিন পর দেখা হতো। কত আনন্দ, খুশি নিয়ে আমরা মাতিয়ে রাখতাম পুরো বাড়ি। তখন চলত নানির বাসায় পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম। কেননা, নতুন ধান মাড়াই করে ঘরে তুলেছে।

নানা বাজার থেকে বড় রুই মাছ, কাতলা মাছ, আরও হরেক রকমের মাছ নিয়ে বাসায় আসত। এ মাছ নানি মা-খালারা রাতে রান্না করে রাখত। নিতান্তই সত্য, শীতকালীন মুখরোচক খাবার হলো ভাপা পিঠা। নানি, মা, খালারা উঠে যেত ভোররাতে। আমরা ও খালাতো ভাইবোনেরা মিলে উঠে যেতাম এ সময়ে এবং অনেক আনন্দ-উল্লাস করতাম। কুয়াশায় ঢাকা নানির বাড়ির উঠানের এক প্রান্তে গনগনে জ্বলন্ত উনুন। সে আগুনের আঁচে উনুনের ধার ঘেঁষে বসে আছি ভাইবোনেরা এবং নানা-মামারা সবাই। হাসিখুশি মা, নানি, খালারাও। নানির সুনিপুণ হাতের পটুতায় ঢাকনা ঢাকা হাঁড়ির ওপরে, একরতি কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে উঠছে আতপ চালের গুঁড়া ঢাকা, নতুন খেজুর গুড় আর নারকেল কোরা দেওয়া ছোট বাটি। নামছে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা।

শীত মৌসুমের শুরুর সঙ্গে পথের ধারে ভাপা পিঠা বিক্রি শুরু হয়েছে। গরম-গরম পিঠা খেতে ভিড় করছে নানা বয়সী মানুষ
ফাইল ছবি

ভাপা পিঠা হওয়ার পর আমাদের মাদুর পেতে চেরাগ, হারিকেন জ্বালিয়ে খেতে দিত ভাপা পিঠা। নানির বাসায় শুধু ভাপা পিঠাই বানাত না, আরও হরেক রকমের মুখরোচক পিঠা বানাত যেমন দুধ, চিতই, নারকেল পিঠা, খোলা চিতই, রস চিতই বা রসের পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা আরও হরেক রকমের মুখরোচক পিঠা।

এখনো ওই স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াই, ফিরে যেতে চাই শৈশবে। সময়ের সঙ্গে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তার মাঝে বেঁচে নেই নানা-নানি। শৈশবের দিনগুলোর মতো সবাই একসঙ্গে যেতে পারি না নানির বাসায় বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে। সবার আগমনে আর নানির বাসা মুখরিত হয় না।

স্মৃতির পাতায় রয়ে গেল আমার প্রিয় জন্মভূমি বাহাদুরপাড়া গ্রাম এবং আমার বাল্যবন্ধু-বান্ধব, যাদের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত খেলাধুলা করতাম। শীতকালে ধান কাটার পর ধান কুড়ানো গর্তে হাত ঢুকিয়ে ধান বের করতাম সবাই মিলে। আর চাইলেও ফিরে যেতে পারব না স্মৃতির পাতায় রেখে আসা শৈশবের শীতকালে।


*লেখক: মো. আজাদ হোসেন, শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা