রেলক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ

লেভেল ক্রসিংটিতে নেই কোনো গেটম্যান ও প্রতিবন্ধক দণ্ড। লাইনের ওপর যানবাহন থাকায় দূর থেকে সংকেত পেয়ে থামিয়ে দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনগামী ট্রেনটি। শহরের উকিলপাড়া এলাকা, নারায়ণগঞ্জ
ছবি: দিনার মাহমুদ

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে রেল দুর্ঘটনায় ১১ জনের স্বপ্নের মৃত্যু। পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে হতাহতের এ করুণ পরিণতি! ইদানীং দেশের বিভিন্ন রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। কয়েক মাসের উল্লেখযোগ্য কিছু সংবাদ শিরোনাম এমন: ভৈরবে এক বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে ৬৫ জনের মৃত্যু, নীলফামারীতে বরেন্দ্র এক্সপ্রেসের ধাক্কায় প্রাণ গেল তিন শ্রমিকের (২২ জানুয়ারি ২০২২), ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্রেনের ধাক্কায় সালমা (২৫) নামের এক তরুণী নিহত (২৭ জানুয়ারি ২০২২), দিনাজপুরের বিরামপুরে ট্রেনের সঙ্গে প্রাইভেট কারের সংঘর্ষে তিনজন নিহত (২ ফেব্রুয়ারি ২০২২), রাজধানীর কারওয়ান বাজারে রেলগেট এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় মো. মনির হোসেন (৪৮) নামের এক ব্যক্তি নিহত (২৪ জানুয়ারি ২০২২), বগুড়ায় ট্রেনের ধাক্কায় জোহরা বেওয়া (৯০) নামের এক নারী নিহত হয়েছেন (২০ জানুয়ারি ২০২২), গাজীপুরের কালীগঞ্জ ও পুবাইলে ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাতনামা দুই যুবক নিহত হয়েছেন (১৮ জানুয়ারি ২০২২), বগুড়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে মনীষা রহমান স্বর্ণা (১৬) নামের এক স্কুলছাত্রী নিহত হয়েছে (১৭ জানুয়ারি ২০২২), ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ গেল এইচএসসি পরীক্ষার্থীর (১১ জানুয়ারি ২০২২), আখাউড়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু (৯ জানুয়ারি ২০২২), কুড়িলে ট্রেনের ধাক্কায় নারীর মৃত্যু (১০ জানুয়ারি ২০২২), রেললাইনে বসে ভিডিও গেম খেলার সময় কিশোরের মৃত্যু (১২ জানুয়ারি ২০২২), ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ গেল এইচএসসি পরীক্ষার্থীর (১১ জানুয়ারি ২০২২), আখাউড়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু (৯ জানুয়ারি ২০২২)। এসব খবর আমাদের সংকটের কথাই বলছে। এগুলোর বেশির ভাগই রেলক্রসিংয়ে ঘটছে। ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়ে ভাবতে হচ্ছেই।

নগরে রেললাইন ঘেঁষে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বাজার। এতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের দুই নম্বর রেলগেট। ছবি: সৌরভ দাশ

রেলের হিসাবে, ২০১৪ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ছয় বছরে রেলে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৭৫ জন। এর মধ্যে ১৪৫ জনই প্রাণ হারিয়েছেন রেলক্রসিংয়ে। দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, গড়ে প্রতিবছর ১৭৮ জন রেললাইনে মৃত্যুবরণ করছেন। রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে মোট রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৫৬১। এগুলোর মধ্যে অনুমোদন নেই ১ হাজার ৩২১টির। সরকারের কমবেশি পাঁচটি সংস্থা রেললাইনের ওপর সড়ক নির্মাণ করে থাকে। এসব ক্রসিংয়ের বেশির ভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সড়কে। এ ছাড়া গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। রেল বিভাগেরও কিছু রেলক্রসিং আছে। হিসাব বলছে, দেশের ৮০ শতাংশের বেশি রেলক্রসিংই অরক্ষিত। লেভেল ক্রসিং দিন দিন পরিণত হচ্ছে মৃত্যুফাঁদে। প্রতিনিয়তই প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেকে। দুর্ঘটনা ঘটার পর বরাবর তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়সারা হয়। কিন্তু পরে কী হলো, তা বেশির ভাগই অন্ধকারে থেকে যায়। কারণ, প্রতিকারের ব্যবস্থার প্রস্তাব জনসচেতনতার জন্য আলোয় আসার দরকার বলে মনে করি।

সংকেত না মেনে উল্টো পথে লেভেল ক্রসিং পার হচ্ছে মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, রিকশাসহ নানা যানবাহন। চট্টগ্রাম নগরের কদমতলী রেলগেট। ছবি: সৌরভ দাশ

বিভিন্ন পত্রিকার সূত্রমতে, রাজধানী ও আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি অরক্ষিত ও অননুমোদিত। কিছু কিছু স্থানে গেটম্যান ও সিগন্যালবার নেই। কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অংশকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রেলওয়ে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এরই মধ্যে এসব ক্রসিংয়ের ৯টিকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে। এসব ক্রসিংয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। নগরীতে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে যে ৯টি রেলক্রসিং চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো মগবাজার, মালিবাগ, তেজগাঁও, সায়েদাবাদ, বিএফডিসি, বনানী, কুড়িল, মহাখালী ও খিলগাঁও রেলক্রসিং।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, শুধু ঢাকার কুড়িল রেলক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৯০ বার ট্রেন চলাচল করে। নগরীতে শুধু রেলক্রসিংই অরক্ষিত নয়, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে রেললাইনও। প্রতিনিয়ত ট্রেনে কাটা পড়ে মরছে মানুষ। তারপরও নেই সচেতনতা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব রেলক্রসিংয়ে মানুষ ও যান চলাচল করে থাকে। ট্রেনে কাটা আহত ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে। কেউ সেলফি তুলতে গিয়ে, কেউ মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন দিয়ে হাঁটার সময়, কেউ হেডফোনে গান শুনতে শুনতে অসতর্কতাবশত হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে, ঘনবসতি এলাকা দিয়ে ট্রেন চলাচলের সময় ট্রেনের হুইসেল শুনতে না পাওয়া, গেটগুলোর আশপাশে দাঁড়িয়ে মাদক বিক্রি, নেশাগ্রস্ত হয়ে রেললাইনে চলাচল, আঁকাবাঁকা পথে ট্রেন দেখতে না পাওয়া ও ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করে ট্রেনে কাটা পড়ছে বা পঙ্গুত্ববরণ করছে বলে কারণগুলো বেরিয়ে এসেছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেললাইনের বেশ কয়েকটি ব্যস্ততম এলাকা। এখানে অনেক স্থানে লেভেল ক্রসিং নেই। এ রুটের অনেক এলাকাতেই রেললাইনের ওপর বসে বাজার। রেললাইনের পাশে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট শিল্পকারখানা। কোনো কোনো কারখানার পণ্য আবার শুকাতে দেওয়া হয় রেললাইনের ওপর। এগুলো থেকেও রেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।

ট্রেন আসছে দেখার পরও অলস ভঙ্গিতে বসে থাকেন বা চলাচল করেন এখানকার বাসিন্দারা। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। মুজগুন্নী, খুলনা
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, রেলপথের দুই পাশে ১০ ফুট এলাকায় চলাচল আইনত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ওই সীমানার ভেতর কেউ প্রবেশ করলে গ্রেপ্তারের বিধান রয়েছে। এমনকি ওই সীমানায় গবাদিপশু প্রবেশ করলে তা বিক্রি করে এর অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। রেলওয়ে আইন ১৮৯০-এর ১২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ট্রেনের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে বা বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড হবে। রেল বিভাগ রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নেওয়াকে সেই ধরনের অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। ফলে দুর্ঘটনার দায় তারা নিতে চায় না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে রেলওয়ে গতানুগতিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রায় সব প্রতিবেদনেরই ভাষা, সুপারিশ ও দায়ী করার পদ্ধতি একই। আবার জনবলসংকটও রয়েছে। রেলক্রসিংগুলোর অবস্থা কমবেশি এ রকমই। গেট আছে তো গেটম্যান নেই। গেটম্যান আছে তো সিগন্যাল বাতি নেই। ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোতে রেল কর্তৃপক্ষ শুধু ‘সামনে রেলক্রসিং, সাবধানে চলাচল করুন’, এমন কিছুÑসতর্কীকরণ সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করে থাকে। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার দায় নিতে রাজি নয় রেল কর্তৃপক্ষ।

পাথর নিক্ষেপ করে ট্রেনের যাত্রীদের রক্তাক্ত করা হচ্ছে। রাজধানী, গাজীপুর জেলাসহ বেশ কিছু রেললাইনে এমন ঘটনা ঘটছে। লেভেল ক্রসিংয়ে সড়ক নির্মাণের সময় রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সমন্বয় করা দরকার। সওজ অল্প কিছু মহাসড়কের উড়ালসড়ক নির্মাণ করেছে। এটার পরিমাণ আরও বাড়ানো যেতে পারে। রেলের নিজস্ব কিছু ক্রসিংয়ে পাহারাদার থাকলেও তাদের বেশির ভাগই অস্থায়ী। জনবল নিয়োগ, ব্যারিকেড বসানো, পাহারাদার নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে আরও চিন্তাভাবনা করা দরকার বলে মনে করি। সর্বোপরি দরকার জনসচেতনতা সৃষ্টি। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। বিভিন্ন লেভেল ক্রসিংয়ে (বিশেষ করে রাজধানী ও আশপাশে) মাইকিং করে, প্রচারপত্র বিলি, রেললাইনের পার্শ্ববর্তী বস্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করে দুর্ঘটনা কমানো যেতে পারে।
লেখক: কবি