আয়াতরা কেন নৃশংসভাবে খুন হয়

পাঁচ বছর বয়সী শিশু আলিনা ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

মাত্র পাঁচ বছরের ছোট্ট আলিনা ইসলাম আয়াত। কতইবা তার দুনিয়া বুঝবার ক্ষমতা হয়েছে? বিশাল পৃথিবীর বুকে তার ছোট্ট জীবনের গণ্ডি পেরোনোর সফর শেষ হলো। এক পাষণ্ডের হাতে নৃশংসভাবে শ্বাসরোধে হত্যা, তারপর কেটে কেটে ছোট শরীরটাকে কয়েক টুকরা করে নালা, পতেঙ্গা—কত জায়গায় ফেলে দিয়েছে! কী মর্মান্তিক। ভাবতে শিয়রে উঠি যে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটছে বর্তমান ডিজিটাল নিরাপদ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমরা কতটা নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে পেরেছি সিসি ক্যামেরা কিংবা টহল পুলিশের মাধ্যমে। কখন, কোথায় কী ঘটনা ঘটছে বা ঘটতে পারে, তা জানি না বলেই আধুনিক প্রযুক্তি কিংবা চৌকস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভ্যুদয়। কিন্তু সতর্ক দৃষ্টি জোরদার না হওয়ার কারণে এমন নৃশংস ঘটনা চোখের সামনেই হরহামেশাই ঘটে চলেছে।

নিজের ঘরেও আজ মানুষ নিরাপদ নয় কেন? মানুষ এতটাই নৈতিক অবক্ষয়ের নিম্নসীমায় পৌঁছে গেছে যে ছোট্ট শিশুটিও আজ হয়ে গেছে মুক্তিপণ নেওয়ার টোটকা। সে শিশুর শরীরে আছে এক পবিত্র নিষ্পাপ আত্মা, যা পৃথিবীর পাপমুক্ত। তবু খুনির বুক কাঁপেনি। মেয়েটির সঙ্গে না জানি আর কী কী হয়েছে।

ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘সিআইডি’ আর ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখে আবির মিয়া নামের ঘাতক আয়াতকে হত্যা করে তার দেহ টুকরা করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলেছে, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। আবিরের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভালো জিনিস শেখার নামগন্ধ নেই, খারাপটাই শিখলি! এখনো অনুসন্ধান চলছে আয়াতের কিছু দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায় কি না। পাওয়া গেলেও তার কোনো প্রকৃত অবয়ব আছে? কারণ, সময় দ্রুতই বদলে দেয় পরিস্থিতির দৃশ্যপট। জোয়ার–ভাটায় কিংবা দীর্ঘ দিনের রোদ–বৃষ্টির আবরণে হারিয়ে গেছে আয়াতের দেহের অবশিষ্ট চিহ্ন। আয়াত মিশে গেছে নদীর পলিতে কিংবা খেয়ে ফেলেছে কুকুর। তার আত্মাটা উড়ে গেছে চিরশান্তির আত্মার জগতে।

যেখানে আমরা একটা ছোট্ট শিশুর নিরাপত্তা দিতে পারি না, সেখানে অন্য বৃহৎ কিছুর নিরাপত্তা দেব কী করে? সড়কে বেসামাল মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। বাজারের নিত্যপণ্যের দ্রব্যমূল্য লাগামহীন। বাসাভাড়া আকাশছোঁয়া। চাকরির বাজার মন্দা। শিক্ষার ক্রমাগত অবনতি। নীতি–নৈতিকতার বালাই নেই। চলছে ঘুষ, চুরি, ঋণখোলাপি, কালো টাকা আর ক্ষমতার দলাদলির নৈরাজ্য। অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো লেগেই আছে। মানুষের শরীরে মশা বাসা বাঁধে আর ডেঙ্গুতে মৃত্যু যেন ঠেকানোই যাচ্ছে না। এতটা খারাপ অবস্থা গত বছরও ছিল না। হঠাৎ কী এমন হলো, চারদিকে এতটা গোলমাল শুরু হলো। আর এসব অস্থিরতার মধ্যে মানুষের ভেতরে ঢুকে গেছে হিংসা–লোভ।

মানুষের সুরক্ষা দেবে রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্রের পুরো নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা হবে খুবই যুগোপযোগী ও টেকসই। প্রতিটি ইউনিয়নে আছে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। তাদের কালেভদ্রে দেখা মেলে। রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের জোরদার করা হয়। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন নিরাপত্তা বিধানে তারা কেন দায়িত্বশীল নয়? এক দিনের জন্য বা শুধু রাষ্ট্রীয় কতিপয় কর্মকাণ্ডের জন্যই কি গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উৎপত্তি? শহরের প্রতিটি এলাকায় টহল পুলিশ কোথায়? অনেক এলাকায় সিসি ক্যামেরা এখনো বসানো হয়নি। বসালেও ঠিকমতো তা কাজ করে না। এগুলোর কোনো তদারকি নেই। যখন ঘটনা ঘটে যায়, তখন ফুটেজ দেখার তোড়জোড় চলে। অথচ চোর ঠিকই চুরি করে চলে যায়। আয়াতদের জোর করে তুলে নিয়ে যায়, অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছুই জানে না! ঘটনা ঘটলেই, থানায় ডায়েরি করার পর কেন হুঁশ হয়?এর আগে কেন নিরাপত্তাবলয়ে থাকে না সংশ্লিষ্ট এলাকা? উন্নত রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকান, তারা কীভাবে নিরাপত্তা বিধান করে রাষ্ট্রে, দয়া করে তা শিখুন। আজ নারীরা একা বাইরে চলবে, তা–ও মুশকিল হয়ে পড়েছে। পথে পথে বখাটেরা উৎপাত করে। অভিভাবকেরা আজ গভীর দুশ্চিন্তায় দিনরাত পার করছেন আয়াতের ওপর ঘটে যাওয়া এমন নৃশংসতা দেখে।

এলাকাভিত্তিক স্থানীয় জনগণ, তরুণ ও প্রবীণদের কাজে লাগান। নিরাপত্তা কমিটি তৈরি করুন। নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিন। পালা করে পাহারা দিন এলাকায়। মানুষ বেঁচে না থাকলে কিসের উন্নয়ন, কিসের কী? বাস্তবতায় ফিরে আসুন। সমাজের অসংগতিগুলো চিহ্নিত করে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করুন। আর যেন কোনো মা–বাবার কোল খালি না হয়। অনেক কষ্টে বুকের ধন যেন তুচ্ছ চাওয়ার কাছে হত্যার শিকার হতে না হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও জোরদার করুন। পথে–ঘাটে পাড়া–মহলায় দিনে–রাতে নিরাপত্তা জোরদার করুন। অকালে যেন আয়াতদের স্বপ্ন হারিয়ে না যায়।

*লেখক: পারভীন আকতার, শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম