রাজধানী ঢাকা দূষণমুক্ত হবে কবে

ফাইল ছবি

ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। সপ্তম শতক থেকে ঢাকায় মানুষের বসবাস শুরু হয়। বর্তমানে ঢাকায় ২ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ বাস করছে। জনসংখ্যার বিচারে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম শহর। প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ২৫ হাজার লোক বাস করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঢাকার নিজস্ব ঐতিহ্য ও গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। এই ঢাকাকে কেন্দ্র করে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ ছাড়া যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আইয়ুর বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা, গণ–অভ্যুত্থান, পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনসহ সব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাজধানী ঢাকা। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম মহান মুক্তিযুদ্ধও ঢাকার অসামান্য অবদান। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জীবনের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এত গৌরব ও ঐতিহ্য থাকার পরও বিভিন্ন সময়ে রাজধানী ঢাকা কেন বসবাসের অযোগ্য শহরের শীর্ষে থাকে?

ঢাকার পরিবেশদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন। অপরিকল্পিত নগরায়ণের প্রভাবে বাড়ছে নগরবাসীর জীবনের ঝুঁকি। সাধারণ মানুষের কাছে ঢাকা একটি স্বপ্নের শহর। তাই একটু ভালো থাকার আশায় গ্রাম থেকে মানুষ কর্মসংস্থানের খোঁজে শহরমুখী হন। দেশের শতকরা ৩৪ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে। এদিকে বাড়তি জনসংখ্যার চাপে পুজিঁবাদীরা নিজেদের স্বার্থে পরিকল্পনাবিহীন অপরিকল্পিত বিশাল বিশাল অট্টলিকা নির্মাণ করছে। দিন দিন ঢাকার পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অতিরিক্ত শিল্পকারখানার কারণে শহরের বায়ুতে বিভিন্ন দূষিত পদার্থ মিশে বায়ুদূষণ করছে। বিশ্বের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) মতে, তিন দিন ধরে বায়ুদূষণের বিশ্বে কখনো প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে ঢাকা, যা উদ্বেগজনক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ুদূষণের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর মারা যাচ্ছে আনুমানিক ৭০ মিলিয়ন মানুষ। বায়ু দূষিত হলে আমাদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকার পরিবেশদূষণ নিয়ে গবেষণা করছে। তাদের মতে, ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হচ্ছে ধুলাবালু। এ ছাড়া বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করছে ইটভাটা, শিল্পকারখানার বর্জ্য, যানবাহনের ধোঁয়া এবং সড়ক ও ভবন নির্মাণসামগ্রী যততত্র ফেলা ইত্যাদি। ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ মেট্রিক টন ধুলাবালু জমে। সেই হিসাবে প্রতি মাসে ধুলাবালুর পরিমাণ হয় ১৩ হাজার মেট্রিক টন। এসব ক্ষতিকর ধূলিকণা প্রতিদিন বাতাসে মিশে মানবদেহে প্রবেশ করছে। দূষিত বায়ুর প্রভাবে মানুষের ফুসফুসের সমস্যা, পেটের সমস্যা, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে  প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ বায়ুদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষত, নিষ্পাপ শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা নানা সমস্যায় পড়ছেন।

আধুনিক শহরে মোট আয়তনের ২০ শতাংশ খোলা জায়গা থাকা দরকার, সেখানে রাজধানী ঢাকায় আছে মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ। ঢাকাকে আধুনিক শহরে রূপান্তরিত করতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো দূরীকরণে প্রতিবছর অনেক টাকা বাজেট পাস করা হয়, কিন্তু এর ফল শূন্য থাকে। আমাদের দেশে শহরের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও তার নিয়ন্ত্রণ রাজউকের হাতে। বর্তমানে রাজউক তার প্রণীত পরিকল্পনা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে অবশ্যই এর ওপর মানুষের চাপ কমাতে হবে। যেসব কারণে মানুষ গণহারে ঢাকামুখী হয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে। ঢাকার বাইরেও কর্মসংস্থানের সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রয়োজন। বিদ্যমান সমস্যাগুলো দূরীকরণে প্রশাসনের দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। তবে প্রশাসনের পক্ষে একা সব সমস্যা নিরসন করা সম্ভব নয়। এ জন্য সচেতন সুনাগরিকের কিছু করণীয় আছে। অনেক সময় আমরা অসতর্কতা বশত ঢাকার পরিবেশ দূষণ করছি। আমাদের বাসার আবর্জনা বাসার পাশের ড্রেন বা রাস্তায় ফেলে দিই। এসব আবর্জনা থেকে আমাদের পরিবেশ সহজেই দূষিত হচ্ছে। আমাদের দেশে ২০০৩ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হলেও আমরা এখনো পলিথিন ব্যবহার করছি। কোমল পানীয় জাতীয় বিভিন্ন প্লাস্টিকের বোতল এখানে-সেখানে ফেলছি। তাই শুধু প্রশাসনকে দোষারোপ না করে রাজধানী ঢাকার সুস্থ, সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করতে সচেতন হতে হবে। সর্বোপরি, প্রশাসন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী রাজধানী ঢাকার দুর্নাম ঘুচবে এবং সুদিন ফিরে আসবে।

লেখক: মো. সাইফুল মিয়া, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়