আমাদের যুবসমাজ, আমাদের প্রকৃত সম্পদ

ফাইল ছবি

বছরজুড়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় প্রতিটি দিনই প্রত্যেকের জীবনে একটি বিশেষ কোনো দিন। এর মধ্যে কিছু বিশেষ দিন, যা জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয়। ঠিক তেমনই ১২ আগস্ট বৃহস্পতিবার ছিল আন্তর্জাতিক যুব দিবস। বিশ্বব্যাপী সামগ্রিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে যুবসমাজের অসামান্য অবদানের জন্য প্রতিবছর আন্তর্জাতিকভাবে যুব দিবস পালন করা হয়। তারুণ্যের বিকাশ ও উন্নয়নে ১৯৯৮ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক যুব দিবসটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সুপারিশের পর ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো পালিত হয়।

যেকোনো দেশের যুবসমাজ সেই দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। বাংলাদেশসহ প্রায় প্রতিটি দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি, এমনকি স্বাধীনতা/মুক্তির আন্দোলনে যুব শ্রেণির উল্লেখযোগ্য অবদান আগামী প্রজন্মের কাছে ইতিহাস হয়ে থাকবে। সম্প্রতি সুইডেনের গ্রেটা থুনবার্গ থেকে শুরু করে পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইদের মতো লক্ষকোটি যুবকের হাত ধরে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এমনকি বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারির মতো বিভিন্ন ঘটনায় পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে কাজ করেই চলেছে।

যেহেতু যৌবনকাল জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় এবং যুবশ্রেণিই একটি দেশের অন্যতম মূল চালিকা শক্তি। আন্তর্জাতিক যুব দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঘটনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে যুবকদের অংশগ্রহণ এবং মতামত নিয়ে আলোচনা করা। সম্ভাবনাময় প্রায় প্রতিটি দেশেই বিদ্যমান যুবশক্তিকে জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার প্রয়াসে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্যই বিশ্বব্যাপী এই যুব দিবস পালিত হচ্ছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি-সুশাসন-শান্তি-প্রগতিশীলতা-সামাজিক ন্যায়বিচার, শিশুর অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, এমনকি দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে এ দেশের যুবসমাজও থেমে নেই এতটুকু। সরকারের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাগুলো যুবসমাজকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর কথা ভাবছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বলে দেয়, সমাজ পরিবর্তনে যুবসমাজের ভূমিকা অপরিসীম।

জাতিসংঘের মতো বিশ্বব্যাপী পাবলিক হেলথের গবেষণাপত্রেও জাতীয় উন্নয়নের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই তরুণ, তথা যুবসমাজের উন্নয়নের বিষয়ে এখন অনেক বেশি মনোযোগী হওয়ার কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীতে ১০-২৪ বছর বয়সী প্রায় ২০০ কোটি তরুণ ও যুবক রয়েছেন, যা মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগের ১ ভাগ। বাংলাদেশের জাতীয় যুবনীতি অনুসারে, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের যুব বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ হিসাবে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই যুব। সে ক্ষেত্রে প্রায় ছয় কোটি তরুণ-যুবশ্রেণির বসবাস এ দেশে। যারা কিনা এ সমাজকে নতুন করে বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। করোনা মহামারির রোষানলে পড়ে পুরো জাতির আজ হাপিত্যেশ অবস্থা! এমতাবস্থায় একদিকে যেমন যুবসমাজের সোচ্চার ভূমিকা জরুরি, অন্যদিকে তাদের সার্বিক উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তরুণ, তথা যুবসমাজের বেড়ে ওঠার জন্য অনুকূল পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষা প্রদান, তথা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকার পূরণ করতে হবে। তাদের আত্মমর্যাদাকে সমুন্নত রাখার জন্য প্রতিটি কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করা খুব প্রয়োজন। শিশু-তরুণ-যুবশ্রেণি যাতে নির্মল আলোয় উদ্ভাসিত হতে পারে, নিজেদের মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করতে পারে, সেদিকে রাষ্ট্রসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বিশেষ নজর দিতে হবে; অর্থাৎ সময়ের প্রয়োজনে পুরো জাতিকে যারা জাগাবে, আজ সেই যুবসমাজকে সুনিপুণ কারুকাজে সাজাতে হবে।

শুধু ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় মত্ত হয়ে ফেসবুক ও ইউটিউব-নির্ভর জাতি হলেই চলবে না; বরং ভবিষ্যতের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে এগোতে হবে কৌশলী হয়ে। অন্যদিকে ধর্মীয়-রাজনৈতিক উগ্রবাদিতা কিংবা মাদকাসক্তি থেকে রক্ষা করার জন্য ক্রীড়া-সাংস্কৃতিক চর্চা খুব প্রয়োজন। নিশ্চয়ই যুবশ্রেণি আমাদের জাতীয় সম্পদ, যেহেতু নিকট অতীতে এ দেশের যুবসমাজই জাতীয় উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখে গেছে। সালাম-বরকত-আসাদসহ অনেকেই পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন করেছেন। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের জয়গান কিংবা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, পরবর্তী সময়ে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে এ দেশের যুবসমাজ।

স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরেও এ দেশের সামাজিক ব্যবস্থাপনায় অশান্তি বিরাজ করছে। বিশেষ ক্ষেত্রে কতিপয় ক্ষমতালিপ্সু মহলের ছত্রচ্ছায়ায় যুবসমাজ যেন মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তারপরও এ যুবসমাজ ঘিরেই আমাদের মণিকোঠায় সুবিশাল স্বপ্নের জাল বুনেছি। আমরা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করি, তরুণ-যুবকেরাই আবার নতুন করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবে। আবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ দেশের যুবসমাজের হাতেই শান্তির, তথা বিজয়ের মশাল জ্বলবে! সময়ের প্রয়োজনে তারা আজ সমাজ পরিবর্তনের নানা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনেও তারা ঐক্যবদ্ধ! সমাজে শান্তি বিারজ করতে আজ যুবসমাজ স্বেচ্ছাব্রতীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। জাতি-ধর্ম-লিঙ্গনির্বিশেষে আজ তারা মানবতার পক্ষে কথা বলছে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজের আরও বেশি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হয়ে দেশমাতৃকার জন্য প্রাণপণে নিবেদন করতে পারে।

প্রতিটি সরকারের চিন্তাচেতনা ও কর্মপরিকল্পনা এমন হওয়া উচিত, যাতে তরুণ-যুবকদের সার্বিক কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে এবং যা সত্যিকার অর্থে পরবর্তী সময়ে ওই যুবসম্প্রদায় জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। বর্তমান সরকার করোনা মহামারি সত্ত্বেও ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সার্বিক উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সমুন্নত যোগাযোগের প্রত্যয় নিয়ে এগোচ্ছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার! একই সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে সঠিক নেতৃত্বের ভার ছেড়ে দিতে হবে ওই তরুণ-যুবশ্রেণির হাতে। আর তাই বিদ্যা-বুদ্ধি আর মানবিকতায় গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারের পাশাপাশি আমাদের প্রত্যেকের।

এইজিং পপুলেশন ইন পাবলিক হেলথের তত্ত্বমতে, যে দেশে সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যুবসম্প্রদায়ের সংখ্যা যত বেশি, সে দেশ তত বেশি কর্মক্ষম হয় এবং জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। অতএব এটি সুস্পষ্ট যে তরুণ-যুবসম্প্রদায়কে সত্যিকারের মানবসম্পদে তৈরি করার লক্ষ্যে খুব ছোট্ট বয়স থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক-মানবিক ও পারিপার্শ্বিক শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন শেষে তারা যেন সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে না থাকে; বরং ব্যবহারিক শিক্ষার বদৌলতে সামাজিক উদ্যোক্তা হয়ে দেশ জাতির সুনাম অর্জন করতে পারে, সে রকম শিক্ষাদান আশু প্রয়োজন। তাহলেই আমরা যুবসমাজকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে পারব। আর এ মানবসম্পদ শুধু নিজ দেশেই নয়, বহির্বিশ্বেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হবে।

আন্তর্জাতিক যুব দিবস বলেই কেবল তাদের জয়গান করতে হবে, বিষয়টি এমন নয়; বরং প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ যুবসমাজের পাশে থেকে, পাশে রেখে, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে ও সঠিক পরামর্শ দিয়ে আগামী দিনের দায়িত্বভার ছেড়ে দিতে হবে প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি পরিবারে, প্রতিটি সমাজে। তাহলেই সার্থক হবে এ আন্তর্জাতিক যুব দিবস। তাই এই কঠিন সময়ে সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান, ‘আসুন, আগামী দিনের শান্তিকামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় তরুণ-যুবদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সংঘবদ্ধ হই, দৃঢ় প্রত্যয়ী হই দ্বিধাহীন চিত্তে! কেননা, আমরা তো জানি যে ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়—তার।’ এ যুদ্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর, এ যুদ্ধ সুশাসন আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার, এ আন্দোলন নিপীড়িত মানুষের পাশে থেকে তাদের মুখে হাসি ফেটানোর! এ আন্দোলন, আপামর জনতাকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়ন ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র গঠনের। একটি সুশীল-শান্তিপ্রিয় সমাজগঠনে যুবসম্প্রদায়ের পক্ষে নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যেকে সাড়া জাগাব। নিশ্চয়ই এই পৃথিবীতে নির্মল বায়ুর নিশ্বাসে বেঁচে উঠবে লক্ষকোটি জনতা ‘মানুষ’ হয়ে। নিশ্চয়ই সেদিন আর বেশি দূরে নয়! পরিশেষে আমাদের মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা উচিত যে ‘আমাদের যুবসমাজ, আমাদের প্রকৃত সম্পদ!’

লেখক: মো. তানজিমুল ইসলাম