নূপুর

অলংকরণ: আরাফাত করিম

রাত পোহালে ছোটাছুটি। প্রভাতে সূর্যের উঁকি দেওয়া সেই সঙ্গে বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে উড়ে যাওয়া। যেন সূর্যের সঙ্গে তাল মেলানো। রোদ্দুর প্রখর হয় আর সখীরা একসঙ্গে জমতে থাকে। নিজ গাঁ থেকে অন্য গাঁয়েও ছুটে বেড়ায়। দশ গাঁয়ের মোড়ল তৈয়ব উদ্দিন খাঁর একমাত্র মেয়ে আম্বিয়া। মেয়েকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছেন বাবা তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তার কারণও আছে। কেননা, তিনি জানেন তাঁর মেয়ে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। মেয়ের দ্বারা মানুষের কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে করেন না খাঁ সাহেব।একদিন খাঁ সাহেব আদরের কন্যা আম্বিয়াকে বলেন, ‘মা জননী, তুমি কও তো শুনি, আসমান বেশি দূরে না কপাল বেশি দূরে।’

আম্বিয়া হেসে বলে, ‘যদি আমি এই প্রশ্নের উত্তর কইতে পারি। তাহলে তুমি কও, আমাকে কী পুরস্কার দিবা?’
আম্বিয়াকে কিছু বললেই বাবার কাছে বায়না ধরে। এটা খাঁ সাহেব জানেন। তাই তিনি মেয়েকে বলেন, ‘তুমি বলো কী চাও?’
আম্বিয়া হাসিমুখে বলে, ‘আমারে এক জোড়া নূপুর দিবা।’

‘তোমার না নূপুর আছে।’
‘আগেরটা পুরান হইয়া গেছে। আমি নতুন নূপুর চাই।’
‘ঠিক আছে দেব। এবার বল, আসমান দূরে নাকি কপাল দূরে?’
আম্বিয়া একটু ভাবান্বিত হয়ে পড়ে। মাথা চুলকাই। কিছুটা সময় পর হাসিমুখে বলে, ‘কপাল বেশি দূরে।’

খাঁ সাহেব মেয়ের বুদ্ধি পরীক্ষা করছিলেন। পরীক্ষায় মেয়ে পাস করেছে। এতে তিনি খুবই আনন্দিত। ইচ্ছা করছে মেয়েকে পাঁচ জোড়া নূপুর এনে দিতে। খাঁ সাহেব বলেন, ‘কেমনে কপাল দূরে! কপাল তো চাইলে ছোঁয়া যায়। আসমান কি চাইলে ছোঁয়া যায়?’
আম্বিয়া বাবার চোখে চোখ রেখে বলে, ‘বাবা কী যে কও না তুমি। আসমান তো চাইলে দেখা যায়, কপাল কি চাইলে দেখা যায়!’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

খাঁ সাহেব অতি আনন্দের সঙ্গে মেয়ে আম্বিয়াকে জড়িয়ে ধরেন। আম্বিয়াও বাবাকে জড়িয়ে ধরে। তাই তিনি আম্বিয়াকে কোনো কিছুতে বাধা দেন না। এমনকি যথাসময়ে আম্বিয়ার নতুন এক জোড়া নূপুরও যায়।

সখীদের সঙ্গে ঘুরেফিরে বর্ষার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আম্বিয়া। নতুন পানি এসেছে। পানির জোয়ারে ভাসছে আম্বিয়ার মন। গোসল শেষ করে নিজ গৃহে প্রবেশ করে। আয়নার সামনে বসে নিজের সৌন্দর্য দেখে মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সেজেগুজে পরির মতো হয়ে যায় আম্বিয়া।

মায়ের ডাকে মধ্য দুপুরে খেতে বসে। মা আম্বিয়াকে মন ভরে দেখেন। কত সুন্দর তার মেয়ে! আম্বিয়া ভাত খাচ্ছে। ‘মেয়েটা খুব সুন্দর করে সাজতে পারে। দেখতে দেখতে গায়ে গতরে অনেক বড় হয়ে গেছে। এবার একটা রাজপুত্র দেখে মাইয়াকে বিয়ে দিতে হবে। মাইয়ার বাপরে কইতে অইব।’ এসব ভাবছে আর মেয়ের চুল থেকে পা অবধি দেখছেন।

হঠাৎ পায়ে দৃষ্টি এসে থেমে যায় আম্বিয়ার মা। এক পায়ে নূপুর। অন্য পা খালি। মা বলে, ‘কিরে মা! তোর এক পায়ের নূপুর কই?’

আম্বিয়া পায়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। সত্যিই নূপুর নেই! কী বলবে বুঝতে পারছে না। নূপুর কোথায় পড়েছে, সেটা মনে করার চেষ্টা করছে।

মা মেজাজ গরম করে বলেন, ‘যা কইতাছি, নূপুর পরে আয়। পা খালি থাহন ভালা না।’
আম্বিয়া ভাবছে নূপুর কোথায় পড়তে পারে। রোদের ঝিকমিক করা বর্ষার পানিতে সখীদের সঙ্গে গোসল করেছে। কত হইচই কত ছোটাছুটি, ডোবাডুবি খেলা, সবই করেছে। পানিতে পড়ল না তো। ভাবতে ভেতরে আঁতকে ওঠে। পানিতে পড়লে আর পাবে না। এর আগে সখীদের সঙ্গে বাড়ি থেকে অনেক দূরে দিঘির কাছে জঙ্গলেও গিয়েছিল। যে জঙ্গলের নাম শুনলে জনজীবন ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। সেই নির্জন জঙ্গলের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি করেছে। সেখানে কোথাও পড়েছে কি না, মনে করার চেষ্টা করছে আম্বিয়া।

আগের দিন বিকেলে খালাতো ভাই মহসিনের সঙ্গে পুকুরপাড়ে বসে গল্প করেছে। মহসিন আম্বিয়াকে পছন্দ করে। আম্বিয়া সে কথা জেনেও না জানার ভান ধরে থাকে। যেন সে কিছু বুঝে না। মহসিনকে বোকা বানাতে আম্বিয়ার ভালো লাগে। কিন্তু আম্বিয়াও মনে মনে মহসিনকে পছন্দ করে। তাকে দেখলে আম্বিয়ার মনে অন্য রকম অনুভূতি হয়। বড্ড বেশি আপন মনে হয়। মহসিন আম্বিয়ার হাত ধরতে চাইলে আম্বিয়া চমকে ওঠে। যেন বিদ্যুতের শক লাগে। আম্বিয়া মহসিনকে ধাক্কা দিলে, মহসিন আম্বিয়াকে জড়িয়ে ধরে। আম্বিয়া আস্তে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলে, ‘এ কী করতাছ, ছাড়ো না।’ মহসিন ছেড়ে দিলে আম্বিয়া দৌড় দেয়। সেই সময়েও নূপুর পায়ে ছিল। নাকি জঙ্গলের ভেতরে পড়েছে কোথাও!

হ্যাঁ, মনে পড়েছে একটা শিকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল আম্বিয়া। বোধ হয় নূপুরটা পড়ে আছে সেখানে। গেলে অবশ্যই নূপুরটা পাওয়া যাবে। কিন্তু এই জঙ্গলে একা যাওয়া যাবে না। ভয়ংকর একটা জায়গা। কয়েকজন সখীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হয় আম্বিয়া। কেউ যাবে না। মহসিনও সকালে ওর বাড়িতে চলে গেছে। অবশেষে সাহস করে একাই ছুটে চলে।

বাড়ি থেকে অনেক দূরে দিঘি। হেঁটে যেতে অনেকটা সময় লাগবে। সূর্যের আলো যেন আম্বিয়ার সঙ্গে সখ্য করেছে। প্রচণ্ড খরতাপে মাঝে একা একা হেঁটে যাচ্ছে আম্বিয়া। ঘামে পুরো শরীর ভিজে গেছে। তারপরও মুহূর্তের জন্য থেমে থাকেনি। নূপুর তাকে আনতেই হবে। বাবার দেওয়া উপহার এই নূপুর। সেটা তার আনতেই হবে।

আর বেশি দূর নয়। দিঘির পাড়ে উঠছে আম্বিয়া। অনেকটা উঁচু। পাড়ে উঠে একটু বসে আম্বিয়া। আরেকটু হাঁটতে হবে। আবার হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু এর মধ্যে আম্বিয়া ঘামে ভিজে টইটম্বুর হয়ে গেছে। যেন দিঘির জলে স্নান করে উঠেছে সে। বাতাস যেন তার রূপ যৌবন গিলে খাচ্ছে। প্রকৃতি যেন আম্বিয়ার রূপে মুগ্ধ।

দিনদুপুরে চারপাশ নীরব নিথর। কোথাও মানুষের ছায়া নেই। শুধু গাছ আর গাছ। বান্ধবীদের সঙ্গে ছোটাছুটির সময় যেমনটা ছিল, এখন মনে হচ্ছে তেমন না। জঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করতেই যেন শরীরে ভয়ের কাঁটা বিঁধে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনে কিছুটা স্বস্তি পায়। আম্বিয়া নূপুর খুঁজছে। এত বড় জঙ্গলে কোথায় পাবে নূপুর। হোঁচট খাওয়া শিকড়ের সন্ধান করছে।

অনেকটা সময় খোঁজার পর লক্ষ করে বেলা শেষ হয়ে এল। এদিকে নূপুর খুঁজে পাচ্ছে না আম্বিয়া। বিকেলের শেষ আলোর ছিটেফোঁটা গাছের পাতা ভেদ করে মাটিতে পড়ছে। সেই আলোতে চোখে পড়ে একটা বিষধর কালো সাপ। ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আম্বিয়ার বুকের ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে যায়। কিছুটা সময় পর দেখে সাপটি চলে গেছে।

এখন বের হতে পারলে সে বাঁচে। এমন ভাবনাতে আতঙ্কিত মনে কয়েকটা কদম সামনে এগোয় আম্বিয়া। হঠাৎ চোখে পড়ল সেই শিকড়টি। কিন্তু আম্বিয়ার এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে ওই শিকড়ের কাছে সাপটি আছে। আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এবার একটু সাহস বাড়িয়ে আরেকটু সামনে এগোয়। না কোনো কিছু নেই। ডুমুরের পাতার আড়ালে নূপুর পড়ে আছে। কিন্তু নূপুরটি হাতে নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে সাপটি কাছেই কোথাও আছে। নূপুরটি ধরতে গেলেই ছোবল দেবে। এই যেন নাগমণির মতো। শঙ্কিত মনে আবার ভাবে আম্বিয়া, সিনামাতে দেখেছে সে, নাগমণি সাপের মহামূল্যবান সম্পদ। কিন্তু নূপুর তো সাপের সম্পদ নয়। এবার সে নূপুর ধরতে যাবে, ঠিক তখনই একটা ডাল ভাঙার শব্দ কানে এল।

আম্বিয়া এদিক–সেদিক তাকিয়ে। দেখে কোথাও কেউ নেই। সেই বুঝতে পারছে কেউ একজন আশপাশে আছে। কিন্তু কে সে? কাউকে সে দেখতে পাচ্ছে না। এদিকে ক্রমেই পৃথিবীতে আঁধার নেমে আসছে। এখন আর মনে সর্পের ভয় নেই। চট করে নূপুরটি হাতে নেয়। এবং হাঁটার জন্য প্রস্তুত হতে চাইলে, কে যেন পেছন থেকে আম্বিয়াকে ধরে ফেলে। মুহূর্তে আম্বিয়া অবাক ও ভিতু হয়ে পড়ে। মাথা ঘোরানোর সাহস পাচ্ছে না। আম্বিয়া বলে, ‘কে?’

লোকটি কোনো কথা বলছে না। আম্বিয়া অনেক কষ্টে পেছনে তাকিয়ে দেখে পাশের বাড়ির মনু কাকা। তার সখী আছমার চাচা। আম্বিয়া খেয়াল করে, মনু কাকার চোখ লাল হয়ে আছে। বিপদ হওয়ার আগে কেটে পড়া ভালো। তাই সে দৌড় দিতে চায়। অমনি মনু মিয়া আম্বিয়াকে জড়িয়ে ধরে। আম্বিয়া নূপুর দিয়ে মনু মিয়ার কপালে আগাত করে। মনু মিয়ার কপাল দিয়ে রক্ত বের হয়। ফলে হিতে বিপরীত হয়। মনু মিয়া হিংস্র হয়ে একটানে আম্বিয়ার ওড়নাটা কেড়ে নেয়।

মনু মিয়া বলে, ‘কিরে তুই তো দেহি এক্কেবারে ভিজ্জা গেলি। আয় আইজ্জা তোর লগে আমিও ভিজমু।’

মনু মিয়া লটকনগাছের সঙ্গে চেপে ধরে আম্বিয়াকে। আম্বিয়ার শরীরের সব শক্তি নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। আম্বিয়া বলে, ‘মনু কাকা এই তুমি কী করতাছ? আমি তোমার মেয়ের মতো।’

মনু মিয়া একটা অট্টহাসি দেয়। আম্বিয়ার মনে হচ্ছে মনু মিয়ার হাসির সঙ্গে আরও যেন অনেকে হাসছে। কিন্তু মনু মিয়া ছাড়া আর কেউ এখানে নেই। আম্বিয়ার ভয়ে সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। আম্বিয়া কেঁদে কেঁদে বলে, ‘মনু কাকা দোহাই আপনার, আমারে চাইড়া দেন।’