মুম্বাই হামলার বর্ষপূর্তিতে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার ডাক জেনেভায়

ভারতে মুম্বাই হামলার ১৪ বছর পূর্তিতে জেনেভায় জঙ্গিবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক কেন্দ্র (আইসিএটি) আয়োজন করেছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের। ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় সেই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। ২০০৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বরে ৬০-২৮৮ নম্বর প্রস্তাবে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেছিল আইসিএটি। সেখানে বলা হয়েছিল, জঙ্গিবাদের বৃদ্ধির কারণে অমানবিকতার শিকার বাড়ছে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছিল, জঙ্গিবাদ দমনে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে মানবিক মর্যাদাকে সম্মান করে এবং আইনের শাসনকে সমুন্নত করে এমন ব্যবস্থা। গ্লোবাল কাউন্টার-টেরোরিজম স্ট্র্যাটেজি পর্যালোচনার শেষ চারটি প্রস্তাবে (এ/আরইএস/৬৬/২৮২, এ/আরইএস/৬৮/২৭৬, এ/আরইএস/৭২/২৮৪ এবং এ/আরইএস/৭৫/২৯১) সবাই গুরুত্ব দিয়েছেন ভুক্তভোগীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং সহিংস চরমপন্থা প্রতিরোধের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মানবাধিকারকে স্বীকৃতি ও সমন্বয়ের ওপর।

জাতিসংঘের বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ নির্মূলের কৌশল বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৌশল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এনজিও এবং সুশীল সমাজকে কীভাবে উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে যথাযথভাবে উত্সাহিত করার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে সম্মেলনে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৮ সালের ২৬ থেকে ২৯ নভেম্বর মুম্বাইয়ে বিধ্বংসী হামলায় বহু বিদেশি নাগরিকসহ ১৮৮ জন প্রাণ হারান। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৯ জন ছিলেন ইসরায়েল, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, জাপান, জর্ডান, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মেক্সিকো, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, স্পেন, চীন, ওমান, ফিলিপাইন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। ভয়ংকর সেই অমানবিক ও বিধ্বংসী হামলায় জঙ্গিবাদের ভয়ংকর ছবি উঠে এসেছিল।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানেই জঙ্গিবাদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের ক্ষত নিরাময়ে সক্রিয় সমর্থন এবং জঙ্গিবাদের প্রতিবাদ।

জাতিসংঘের নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গিবাদী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়েবার ১০ পাকিস্তানি সদস্য মুম্বাইয়ের ভবন, ক্যাফে, হোটেল, উপাসনালয়, গণপরিবহন কেন্দ্র, রেলস্টেশন এবং সরকারি হাসপাতালে নির্দয়ভাবে ১৬৬ জনকে হত্যা করেছেন। ৯ বন্দুকবাজ ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষী গুলিতে মারা গেলেও আজমল কাসভ নামের এক পাকিস্তানি হামলাবাজ জীবিত অবস্থায় ধরা পড়েন। পরে অবশ্য বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়।

জঙ্গিরা পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে নৌকায় করে মুম্বাই গিয়েছিলেন। ভারতে ঢোকার আগে তাঁরা একটি ভারতীয় মাছ ধরার ট্রলার ছিনতাই করে চারজন ক্রু সদস্যকে হত্যা করেন। ঘাতকেরা তাঁদের বর্বরতা বহর বোঝাতে নৃশংসভাবে নৌযানটির ক্যাপ্টেনের গলা কাটেন।

জঙ্গিরা ল্যান্ডমার্ক গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার স্মৃতিস্তম্ভের কাছে মুম্বাই বন্দরে নৌকা থেকে নেমেছিলেন। তারপর একটি পুলিশের ভ্যানসহ গাড়ি, ট্যাক্সি ছিনতাই করে নিজেদের তিনটি ঘাতক বাহিনীতে ভাগ করে শুরু করেছিল নাশকতার তাণ্ডব। ভয়ংকর জঙ্গি হামলায় ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইকে ধ্বংস করতে পাকিস্তানি হামলাবাজরা অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ও গ্রেনেড ব্যবহার করেন।

আটটি হামলা হয়েছে দক্ষিণ মুম্বাইয়ে। ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস, মুম্বাই চাবাদ হাউস, দ্য ওবেরয় ট্রাইডেন্ট, দ্য তাজ প্যালেস অ্যান্ড টাওয়ার, লিওপোল্ড ক্যাফে, কামা হাসপাতাল, দ্য নরিমান হাউস, মেট্রো সিনেমা এবং টাইমস অব ইন্ডিয়া ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পেছনের একটি গলিতে। মুম্বাইয়ের বন্দর এলাকার মাজাগাঁও এবং ভিলে পার্লেতে একটি ট্যাক্সিতেও বিস্ফোরণ হয়।

জেনেভায় শুক্রবারে এ সম্মেলনে বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লন্ডনের ব্রিজ ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের পরিচালক প্রতীক দাতানি, দিল্লির হিমালয়ান রিসার্চ অ্যান্ড কালচারাল ফাউন্ডেশনের মহাসচিব কে ওয়ারিকু, প্যারিসের আইডিয়াল ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট স্টিফেন মিচট, লন্ডনের লেখক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রিয়জিৎ দেবসরকার, ফ্রান্সের খাইবার ইনস্টিটিউটের মানবাধিকার রক্ষাকারী ফজল রহমান আফ্রিদি প্রমুখ। অনুষ্ঠানের সভাপতি ও সমন্বয়কারী ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অ্যাগেইনস্ট টেররিজমের পরিচালক মি. বিরো দিওয়ারা।

বক্তারা সবাই ভয়ানক নৃশংসতার বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি মুম্বাইয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন। তাদের মতে, এখন সময় এসেছে যে গোটা দুনিয়ার জঙ্গিবাদবিরোধী সব দেশকে জঙ্গিবাদের উপযুক্ত সংজ্ঞা নির্ধারণ করে এবং তার কারণ খুঁজে সেটিকে ভোঁতা করার। কারণ, সন্ত্রাস কোনো জাতি, ধর্ম বা অঞ্চলের প্রতি কোনো বিচার বা বিবেচনা করে না। সহিংসতার আড়ালে স্বাধীনতাসংগ্রামের ধারণাকে বৈধতা দেওয়ার এবং নিরপরাধের রক্ত ঝরানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই বলেও বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, মুক্ত বিশ্বের সর্বসম্মত কণ্ঠে সহিংসতার এবং বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের (সেটি ভালো হোক বা খারাপ হোক) নিন্দা করা উচিত।

জঙ্গিবাদের শিকার ব্যক্তিদের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে প্যারিস, দিল্লি ও লন্ডনে সন্ত্রাসবাদের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে বহুপক্ষীয় সম্মেলন আয়োজনের কথাও বলা হয়েছে জেনেভায়।

প্যারিসের আইডিয়াল ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট স্টিফেন মিচটকে ঢাকা থেকে আবু সাঈদ এবং লন্ডন থেকে প্রিয়জিৎ দেবসরকারের লেখা ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ১৯৭১’ বইটি উপহার দেওয়া হয়। বইটির ভূয়সী প্রশংসা করে মিচট ইংরেজি ও ফরাসির মতো ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদের অনুরোধ করেন। লেখকেরা জানিয়েছেন, সেই কাজেও তাঁরা হাত দিয়েছেন।

*লেখক: লেখক ও গবেষক, লন্ডন