চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির...

ফেসবুক
রয়টার্স

প্রথম আলোতে সংবাদ পড়ে জানা গেল, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশে এখন থেকে শিক্ষকেরা সরকারের সমালোচনা করতে পারবেন না, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো বিষয়ে স্বাধীন মতামত দিতে পারবেন না।

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করব, যেখানে আমি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। ঘটনার স্থান কানাডার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস এবং সময়কাল ১৯৯৫ সালের জুন মাস। কানাডা সরকারের অনুদানে বিদেশি ছাত্র হিসেবে ওই ক্যাম্পাসে পড়ছি। মাঝেমধ্যে ক্লাসেও পড়াচ্ছি। এ ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসে গিয়ে না পড়ানো, কিংবা শিক্ষকদের ধর্মঘট অবশ্যই এক বড়মাপের ব্যতিক্রমী ঘটনা। এখানে প্রতি সেশনে প্রায় সব ক্লাস রুটিনমাফিক হয়। পুরস্কার পাওয়া শিক্ষকও যথাসময়ে ক্লাসে আসেন, বিনা নোটিশে ক্লাস কামাই করেন না।

একদিন ক্লাসে আলোচনা হচ্ছিল ২ আগস্ট ১৯৯০ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সময়কালে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’। ইরাকের অপরাধ, ইরাক কিছুদিন ধরে তেলসমৃদ্ধ কুয়েত দখল করে রেখেছে। যা হোক, যুদ্ধের প্রতিবাদে আমার সেদিনের বক্তব্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টসহ কানাডার প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের তীব্র সমালোচনা। ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই মনে হলো যুদ্ধের বিরোধী। তবে ক্লাসে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বিশাল হওয়ায় যুদ্ধ সমর্থনকারীদের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। তারাও কিন্তু শান্তভাবে আমার বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনল। কেউ কেউ যুক্তির ধার দিয়ে সেই বক্তব্য খণ্ডন করার চেষ্টা করল। সেদিন কেউই উত্তেজিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়নি—‘গো ব্যাক টু বাংলাদেশ’।

ওই ঘটনার দু–তিন দিন পর ইউনিভার্সিটির ‘অফিস অব ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস’ থেকে একটি চিঠি পেলাম। সামান্য শঙ্কিত হয়ে চিঠি খুলে বুঝলাম, সব বিদেশির কাছে এ চিঠি পাঠানো হয়েছে এবং তাতে জানানো হয়েছে যেকোনো পরিস্থিতিতে বিদেশি ছাত্রছাত্রী, গবেষক ও শিক্ষকেরা যেন কোনোভাবে মনে না করেন যে তাঁদের মতামত ও বক্তব্যে লাগাম টেনে চলতে হবে। ইউনিভার্সিটি চায়, ক্যাম্পাসের সবাই অসঙ্কোচে ও নির্ভয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করুন। চিঠিতে বিশেষ জোর দিয়ে যে কথা বলা হয়েছে, তা হলো, ইউনিভার্সিটিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার অর্থ শিক্ষার অগ্রগতি রুদ্ধ করা। আরও বলা হয়েছে, এক অগ্রণী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষার স্বার্থে ইউনিভার্সিটি কারও শালীন আর শাণিত মতামতে লাগাম টানতে চায় না।

পরে প্রায় এক বছর বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে ওই বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে অতিথি বক্তা হয়ে সে দেশের সরকারবিরোধী বিভিন্ন মতামত নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছি। এমন কঠোর সমালোচনা করায় কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হতে হয়নি। প্রশ্ন হলো, শিক্ষা-দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হেঁটে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কোন মহার্ঘ লাভ করতে চাইছে? মনে এ প্রশ্নও জাগে যে এক গণতান্ত্রিক দেশের শিক্ষার নিয়ামক সংস্থা হঠাৎ কেন স্বৈরতান্ত্রিক কিংবা কমিউনিস্ট শাসকের মতো বিরুদ্ধ সমালোচনা, অপছন্দের চিন্তা ইত্যাদির কণ্ঠ রোধ করতে চাইছে?
*লেখক: গোপাল সেনগুপ্ত, মন্ট্রিয়ল, কুইবেক, কানাডা

আরও পড়ুন