সুইজারল্যান্ড - আলোর নিচে অন্ধকার

খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট। ছবি: সংগৃহীত
খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ব নাগরিক সমাজের মতে, শিক্ষা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান আর চিকিৎসা—এই মৌলিক চাহিদাগুলো যখন সামনে আসে নাগরিকদের বেলায়, সুইজারল্যান্ড তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষকের মতে, খাদ্যের মৌলিক অধিকারের বিষয়ে সুইজারল্যান্ড কখনো আপস করে না—করোনাভাইরাস মহামারির এই দুঃসময়ে জেনেভাসহ দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, এনজিও এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো বৈধ এবং অবৈধ নাগরিকদের মধ্যে খাদ্যসহায়তার বিতরণ তা-ই প্রমাণ করে। যদিও অনেকে মনে করেন, আন্তর্জাতিক চাপে পড়েই সুইজারল্যান্ড এই পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু বংশপরম্পরায় সুইস জনগণ এতটাই উদার যে, বাস্তবতার নিরিখে এই দোষারোপ ধোপে টেকে না। কয়েক মাস ধরে প্রবণতাটি দৃশ্যমান এবং ক্রমবর্ধমান।

মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক রাজধানী জেনেভা সুইজারল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং এখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর সব সময় প্রশংসা করা হয়। জনসংখ্যার কিছু অংশের খাদ্যের খুব প্রয়োজন হলে জনগণ দেশে মৌলিক অধিকারগুলোর একটি ঝুঁকিতে পড়ার আগে এমন হতে পারে, তা বিশ্বাস করেনি। তারা হঠাৎ করেই সচেতন হয়ে ওঠে, খাদ্য যে একটি মৌলিক অধিকার এবং এটি প্রয়োজন হলে এটির গ্যারান্টি দেওয়া সমাজের দায়িত্ব, সেটা বুঝতে একটুও দ্বিধান্বিত হয়নি।


প্রায় ২৫ সুইস ফ্রাঁ (২২০০ টাকা) মূল্যমানের একটি সাহায্য প্যাকেট পাওয়ার জন্য গত শনিবার দুপুরের দিকে বিশ্বের অন্যতম ধনী শহর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রায় ৩ হাজার শহরবাসী স্টেডিয়ামে লাইন ধরেছিলেন। কেউ কেউ ছোট বাচ্চা নিয়ে এসে ছয় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করেছিলেন। কেউ কেউ এসেছিলেন হুইল চেয়ারে করে।

বিশ্বের অন্যতম ধনী শহর জেনেভায় বিনা মূল্যে খাদ্যের জন্য দীর্ঘ লাইন। ছবি সংগৃহীত
বিশ্বের অন্যতম ধনী শহর জেনেভায় বিনা মূল্যে খাদ্যের জন্য দীর্ঘ লাইন। ছবি সংগৃহীত

চিকিৎসার ক্ষেত্রে জেনেভা পশ্চিম ইউরোপের অন্য দেশের মতো করোনভাইরাস সংকটে এতটা আঁকড়ে নেই। শহর ও তার আশপাশের শহরতলিতে অর্ধ লক্ষাধিক জনসংখ্যার ৩০০ জনেরও কম বাসিন্দা মারা গেছেন, আর পুরো দেশে মৃতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজারের কাছাকাছি।
কোভিডের কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকে সংকট জেনেভার মধ্য এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠেছে। অননুমোদিত, অবৈধ এবং স্বল্প বেতনের শ্রমিকেরা প্রায়ই এমন একটি শহর সম্পর্কে ভুলতে বসেছেন, যা পৃথিবীখ্যাত চকলেট, পনির (চিজ), ব্যাংকিং স্বর্গ, ঘড়ি নির্মাতা এবং জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রেডক্রস রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন বিশ্ব সংস্থার জন্য সুপরিচিত। হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং ধনী পরিবারগুলো তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও গৃহকর্মীদের চাকরিচ্যুত করেছে। কার্যত লকডাউনের প্রতিক্রিয়ায় সুইস অর্থনীতির ছায়ায় কাজ করা কয়েক হাজার মানুষ মার্চ মাসে রাতারাতি তাঁদের চাকরি হারিয়ে ফেলেন, যাঁরা অবৈধভাবে বসবাস করছিলেন।

কোভিড-১৯ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের রক্ষা করতে ২০ মার্চ থেকে বন্ধ জেনেভার বিখ্যাত ‘ফোয়ারা’। খুলবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে। ছবি লেখক
কোভিড-১৯ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের রক্ষা করতে ২০ মার্চ থেকে বন্ধ জেনেভার বিখ্যাত ‘ফোয়ারা’। খুলবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে। ছবি লেখক

রাষ্ট্রীয় সমর্থন আদায়ে অক্ষম, বেশির ভাগ মানুষই এখন বেঁচে থাকার জন্য দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য। শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক এবং নগর কর্মকর্তাদের একটি সাপ্তাহিক খাদ্য ব্যাংক স্থাপন করতে অনুপ্রাণিত করে।
লরা কটন, একজন সুইস-ব্রিটিশ, হাসপাতালের সাজসজ্জার কাজ করেন। তিনি এখন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘এখন শুধু টাকা টাকা এবং টাকা চাই আর যদি না হয় পনির এবং চকলেট দিয়ে সাহায্য করুন। তবে কোভিড -১৯ আমাদের পিঠ দেখিয়েছে।’


করোনাভাইরাস সুইজারল্যান্ডে পৌঁছার আগেই বাংলাদেশের ৩৯ বছর বয়সী এক যুবক ইতিমধ্যে দারিদ্র্যের কবলে জীবন কাটাচ্ছিলেন। তিনি রেস্তোরাঁয় ক্লিনার হিসেবে মাসে ১৫০০ সুইস ফ্রাঁ উপার্জন করেন, যা ব্যয়বহুল জেনেভাতে তাঁর দুই সন্তানকে খাওয়ানো, ঘর ভাড়া দিয়ে সংসার চালানোর জন্য যথেষ্টই নয়।

রোলেক্স ঘড়ির সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ড। ছবি: লেখক
রোলেক্স ঘড়ির সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ড। ছবি: লেখক

খাদ্য ব্যাংকে দান করতে এসেছিলেন শহরের কিছু ধনী বাসিন্দা, যাঁরা তাঁদের পোর্শ (Porsches), টেসলাস এবং মার্সেডিজ করে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন। এঁদের একজন স্টেয়ার্ন পরিবারের এক সদস্য পরিস্থিতি দেখে কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, তিনি লজ্জিত জেনেভার এহেন পরিস্থিতিতে। অনেকেই বলছেন অবৈধ নাগরিকদের বৈধ করে নিতে। বিষয়টি সুইজারল্যান্ডের মানবিক এবং আইনি—উভয় দিক দিয়েই উপলব্ধি করা উচিত।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার জেনেভাসহ পুরো সুইজারল্যান্ডে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে হ্রাস পেয়েছে, কর্তৃপক্ষকে সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধগুলোকে স্পষ্টতই কমিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। কিন্তু সংকটের সময় প্রতি মাসে সুইস অর্থনীতিতে ১১-১৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে।