ভালোবাসায় মোড়া ঈদ

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত বছর থেকে একাই রোজা ও ঈদ উদ্‌যাপন করতে হচ্ছে আমাকে। বাচ্চা দুজন কলেজে। ক্লাস, পরীক্ষা সব এ সময়েই যেন বেশি করে হয়। গত বছর বা এ বছরও আত্মার আত্মীয়রা পাশেই আছে। বহু বছর মা-বাবা, ভাই-বোনকে দেশে রেখে প্রবাসী। খালা, মামা, চাচারা একই দেশে হলেও প্রায় পাঁচ ঘণ্টার দূরত্বে আছেন। সুতরাং সানদিয়াগোতে থাকা ছোটবড় সমবয়সী সবাইকে নিয়েই আনন্দের এই ছোট্ট জীবন চলছে।

এত এত ভালবাসার মানুষ, কার নাম ছেড়ে কার নাম বলব, তবু প্রথম আলো ঈদে প্রিয়জন কাকে কাকে মিস করছি, জানতে চাওয়াতে মনের জানালা খুলে দিলাম। পবিত্র রোজার শুরুটা হয়েছে যেকোনো কারণে অসুস্থতা নিয়ে। যেদিন থেকে আমার একাকী জীবনের শুরু, ডা. শেলি আপা সেদিন থেকে আমার নিজের বোনের মতোই পাশে আছেন, মানে ছায়া হয়ে। আমার মতো খাদকের প্রাণে এমন কোনো জিনিস নেই, যেটা পাইনি না চেয়েও। সব সময়ই তিনি অন্য রকম, তবে  তাঁর এত বছরের ভালোবাসা সাক্ষর ছোট্ট লেখায় প্রকাশ করা অসম্ভব। পবিত্র রমজানের শুরুতে ছোট্ট একটা সার্জারি হবে, তাঁকে কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলেছিলাম। রোজাতে সবার তারাবিহর নামাজ, রোজা রাখাসহ কত শত ব্যস্ততা। তবু আমার ছেলে আমাকে নামিয়ে দেবে আর তুলে নেবে শুনে উনি কিছুতেই রাজি হলেন না। নিয়ে গেলেন আউট পেশেন্ট সার্জারিতে। নিয়ে যাওয়ার আগে ইফতার, লাঞ্চ, ডিনারসহ নিজের গাছের ফল পর্যন্ত সাজিয়ে দিয়ে গেলেন আমার জন্য। ছোট অস্ত্রোপচার, হয়তো ঘণ্টাখানেক সময় লেগেছে। পাশে দাঁড়িয়ে ক্রমে দোয়া পড়া, কপালে আইস প্যাক দিয়ে যাওয়া, অস্ত্রোপচারের পর রক্তমাখা কাপড়ের বদলে শুকনা কাপড় আমাকে এনে দেওয়া নার্সকে বলে, আইস আর ওয়ার্ম কম্প্রেশানের ব্যবস্থা করা, সব তিনিই করেছেন। একজন সাধারণ মানুষের প্রাণের দোয়া এই মানুষটা এবং তাঁর প্রিয়জনের জন্য সারা জীবন থাকবে। তাঁর বাসায় আর সবার সঙ্গে ইফতার করতে পারিনি এ বছর। কারণ সুস্থ হতে সময় লেগেছে। মিস করেছি অনেক আপনজনকে।

কোনো এক মন খারাপের দিনে ডালিয়ার আপার বাসায় এক–দুই মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার গেলাম ইফতার বা ডিনার করতে। এহেন কোনো খাবার নেই, যা খাইনি বা নিয়ে আসিনি। কিন্তু পাশে থাকার মতো ভালোবাসাময় কথাগুলো মন খারাপের দিনেও মন ভালো করে দেয়। নিশুর সঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেসে গিয়ে বাংলাদেশি দোকানে আরাম করে ইফতারি খাওয়া এত আনন্দের ছিল, মনে হয়েছে যেন বাংলাদেশে আছি। ছোট্ট নাম না জানা বছরখানেকের একটা বাবু নিশুর কাছ থেকে মুড়ি চেয়ে তা ফেলে বাটিটা নিয়ে ঘুরছিল কী মহা আনন্দে। দেখে ওর মা–মণির সেকি হাসি। ঈদি নেওয়ার টেকনিকটা নাকি তার দারুণ। এরপর গেলাম ছোট্ট ঈশিতার বাসায় কাজের পর ইফতার করতে গত সপ্তাহে। এহেন কোনো দেশি বা বিদেশি ইফতারি আর বাদ নেই। সে সারা জীবনই এমন। কীভাবে পারে, সেটা জানতে হলে দ্বিতীয়বার জন্ম নিতে হবে আমাকে।

ঈশিতার বাসার রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে দরজা পর্যন্ত কিছুতেই পৌঁছাতে পারতাম না, যদি তুলি আর ওর হাবির সঙ্গে আমার দেখা না হতো। তুলি বুয়েটের, কিন্তু আমরা একই বয়সী। এত কেয়ারিং, ভালো মানুষ বন্ধু থাকলে জীবনে কোনো কঠিন সময় পার করা বোধ হয় অনেক কঠিন হয় না। রুবার, সোমা আপু, ছোট্ট মৌটুসি, সোনিয়া সব সময় খোঁজখবর নেওয়াতে এই রোজার মাসটা দারুণ কেটেছে। শাখী, আমার লস অ্যাঞ্জেলেসের হীরা খালামনি, নাঈমার ভালোবাসাময় কুশল এবং প্রতিটা দাওয়াতে আমি মনে মনে অবশ্যই আছি। শারমিন আমার সব সময়ের বন্ধু। ওর কথা আগে লিখেছি দেখে আপাতত আর লিখলাম না।

জয় আমার কাজের কাছের বন্ধু। সাহ্‌রিতে খাবার জন্য কফি আর স্যান্ডউইচ নিয়ে সে দেখি ভোরে হাজির সেদিন। তার ছয় মাসের ছোট্ট মা–মণির ছবি সব সময় দেখায় সে। জানে ভুবনমোহিনী অড্রের প্রেমে আমি পাগল। আমার কঠিন দিনগুলো আনন্দের হয় ওকে দেখলে। এ্যানা তার হাসপাতালে যে তিন মাস কাজ থাকে সে তিন মাস নাশতা, দুপুরের খাবার, ইফতার যে সময়ে যা ফিট করতে পারে, নিয়ে আসে। এবারের রোজায় পুরোটা সে বাগে পেয়েছে আমাকে। আমি প্রচুর ওজন বেড়েছে থেকে শুরু করে হালাল–হারাম বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সে কসকো থেকে কোশার খাবার কিনে আনা শুরু করেছে। রোজার সময় ক্লারি, ডিউক, প্যাম, স্টু সবাই অ্যাডমিশন করে দিয়ে কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে। কাজটা অনেক কষ্ট হলেও অনেক আনন্দের উৎস আমার জন্য। কারণ, জানি কাজে গেলেই আমার পরিবারের কেউ না কেউ থাকবে সেখানে। ভুলেই যাব জীবনে দুঃখ বলে কিছু আছে।

রোগীরা মাঝেমধ্যে প্রবল আনন্দের কারণ হয়েছেন সব সময়ের মতোই। কোভিডের কারণে হ্যান্ডশেক করা বন্ধ অনেক দিন ধরে। সেদিন রোগী বলে বসলেন তোমার হাত ছুঁয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই। মে গড ব্লেস ইউ অ্যান্ড ফ্যামিলি। চলে যাওয়ার সময় একগুচ্ছ সূর্যমুখী ফুল, নানা রঙের আমার জন্য একজন রেখে গেল। মাস্কের মধ্যেও আমার হাসি নাকি তাঁর ফুলের মতো মনে হয়েছে। যাক তাঁদের কথা অন্য সময়ের জন্য তোলা রইল।

যাঁরা প্রতি রোজায় যত্ন করে ফান্ড রেইজ করে দেশে অনেকের ইফতার, সাহ্‌রি বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন তাঁদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। সংগত কারণে কারও নাম শেয়ার করছি না তবে আপনাদের কারণে আমরা প্রবাসীরা দেশের খুব কাছাকাছি থাকি। প্রাণের দোয়া রইল।

ঈদ এসে গেছে প্রায়। আমার খালা আগেই দিয়ে গিয়েছিল শাড়ি আর ফ্লোরটাচ জামা। শেলি আপাও দিয়েছেন শাড়ি আর ফ্লোরটাচ। দেশে গিয়েছিলাম মাস কয়েক আগে, তখন মা–বাবা–ভাইবোনও দিয়েছে কাপড়। এবারের ঈদ হবে বারাবরের মতোই ঈদের নামাজ পড়ে সরাসরি শিউলি ভাবীর বাসায়। সব ঈদের শুরুটা হয় শিউলি ভাবী বা মিশি ভাবীর বাসায় হয় নামাজের পরপর, ওনারা তিন ভাইয়ের বউ একসঙ্গে সবার জন্য আয়োজন করেন। দোকানের মতো এত স্বাদের রকমারি মিস্টি আমি কাউকে বানাতে দেখিনি। ছেলে নাভানের সকালে ক্লাস নেই, তাই সে আর আমি যাব পাহাড়ঘেরা পথে ওশান সাইড।

মোটামুটি অনেকের সঙ্গে দেখা করে ব্রাঞ্চ (সকাল ও দুপুরের খাবার একসঙ্গে) শেষ করে নাভানকে নামিয়ে দেব বাসায়। তার ক্লাস আছে। এরপর কনি আয়োজন করেছে পটলাক লাঞ্চ। দারুণ ভালো এবং হাসিখুশি মেয়ে কনি, কেমন করে যেন সবার বাচ্চার সবচেয়ে পছন্দের আন্টি সে। যে ছবিটা শেয়ার করছি আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে, সেটাও গত ঈদে কনির বকা খেয়ে ছেলেমেয়ে আমার সঙ্গে তুলেছে। তারপর চারটা থেকে আরেক সোনিয়ার বাসার দাওয়াত। ওর সব রান্না তো অসাধারণ বটেই, তবে চটপটির হাঁড়ি বাসায় নিয়ে আসার চেষ্টা কখনো করব না, সে কথা বলিনি আমি কখনোই।

রাতে যাবে লাবণ্য আপুর বাসায়। আমার চেয়ে মাত্র এক বছরের বড়। তবে মেডিকেলের বলেই কি না, জানি না। তার চেয়ে বড় অনেককে তুমি করে বললেও তাকে লাবণ্য বলাটা রপ্ত করতেই পারলাম না। রাতের সে দাওয়াতে মেয়ে নাওয়ারও আসবে তার ক্লাস শেষ করে। তাদের সমবয়সী অনেকেই আসবে তো। আমার ছেলে–মেয়ে একসঙ্গে বড় হয়েছে। সুতরাং, আমার মতোই সব বন্ধুর জন্য প্রাণের টান তাদেরও আছে।

ঈদে মা–বাবা–ভাইবোনকে অসম্ভব মিস করি। মিস করি দেশের সব বন্ধুবান্ধবকেও। কিন্তু আশপাশের বন্ধুদের ভালোবাসায় অনেক আনন্দের একটা দিন কাটে। বা পুরো রোজার মাস কাটে।
সবশেষে সবাই দোয়া করবেন। ঈদের দিনে আমি সিক কল মানে দুই হাসপাতালের যে কেউ অসুস্থ হলে আমাকে গিয়ে কাজ করতে হবে। যেন ডাক না পড়ে ঈদের দিন। ছয় মাস আগে থেকে ছুটি চাইতে হয়, সুতরাং ঈদের আগের দিন আর পরের দিন—দুদিনই আমার ছুটি। তবু আশায় থাকলাম পুরো পৃথিবীর আনন্দের সঙ্গে আমার ঈদটাও কাটাবে বন্ধুদের মাঝে। সবাইকে ঈদ মোবারক।