দেশ ছেড়ে আসতে যেমন লাগে

ছবি: সংগৃহীত

প্রায় ২৪ বছর বিদেশে থাকি। বয়স বেড়েছে বলে আবেগ অনেক কমে গেছে। যখন দেশে বেড়াতে যাই, কয়েক দিন পরেই এখানকার ঘরবাড়ি, পরিবেশ মিস করতে থাকি। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু যখন চলে আসার সময় হয়, তখন কেমন লাগে? এই অনুভূতিটা আমি হুমায়ূন আহমেদ থেকে বর্ণনা করতে চাই: এক ভদ্রলোক আমেরিকার ভিসা পাওয়ার জন্য তিন-চার বছর প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনোভাবেই ভিসা পান না। একবার খ্রিষ্টান হয়ে ভিসা পাওয়ার চিন্তাও করেছিলেন। হঠাৎ উনি ভিসা পেয়ে যান। ভিসা পেয়েই তাঁর কান্না পেয়ে গেল! এত সংগ্রাম, এত কিছু এই দেশ ছেড়ে যেতে? রিকশায় করে বাসায় ফিরছিলেন, দরিদ্র রিকশাওয়ালার জন্য পর্যন্ত তাঁর মন কেমন করতে লাগল! আর রিকশায় চড়ব না? বৃষ্টিভেজা রাস্তায় ব্যাঙ ডাকছিল! এই ডাক আর শুনব না? ময়লা, কাদামাটিতে লেপটে থাকা দেশটার জন্য তার বুকের মধ্যে হু হু করতে থাকল! এর কোনো ব্যাখ্যা তাঁর কাছে ছিল না। কিন্তু গভীর কান্নায় সে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল!

আমার অনুভূতিটা ঠিক এ রকম হয় দেশ ছেড়ে আসার ঠিক আগের দিন। বন্ধুদের কাউকে বলি না কবে যাচ্ছি। আগের দিন সময় চলে যায় বুলেটের মতো। প্রতিবার আগের দিন সন্ধ্যায় প্রিয় ছেলেবেলার মিরপুর এলাকার গেটের উল্টো দিকের যাত্রী ছাউনিতে থাকা টং দোকানে দাঁড়িয়ে দুই কাপ চা খাই কিন্তু চোখ ভেসে যেতে থাকে জলে! অন্ধকারে সেই জল কেউ যাতে না দেখে, সে ব্যাপারে সাবধান থাকি। টিস্যু পেপারে নাক চোখ মুছি বারবার! তবু শেষ হয় না মোছা! আমার মতো অভাজন সোহেলের চোখের পানির কি দাম আছে? দেশ তো আমাকে বিদায় দেয়নি! আমি নিজে দেশ ছেড়ে গেছি। তবে কেন কান্না? যুক্তি নেই কোনো। তবে কান্নায় কোনো ভেজাল নেই। এখন লিখতে গিয়ে পর্যন্ত বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে! হঠাৎ হঠাৎ বড় ভাইসম বিল্লাল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় তখন। তিনি এলাকায় ঘুর ঘুর করেন সব সময়। গত ২৪ বছর একই রুটিন। তাকেও চা খাওয়াই। তবে ওনাকে আমি খুঁজে নিই না। কীভাবে যেন হাজির হন। ভবঘুরে লোক! ঘোরাই তাঁর কাজ! রাত নয়টার মধ্যে বাসায় ফিরি। আম্মার চোখ ফোলা থাকে। কিছু বলি না। আমাদের ফ্লাইটগুলো খুব ভোরবেলা থাকে। গভীর রাতে বাসা থেকে বের হতে হয়। আমি কাউকে সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দর যাই না। ট্যাক্সি বলে রাখি। সে তুলে নিয়ে আসে। ছোট ভাই সঙ্গে আসতে চায় কিন্তু আনি না। রাতে প্রতিবার আম্মার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদতে কাঁদতে বলবে, যদি ভালোমতো পড়া লেখাটা করতি, তাহলে বিদেশে থাকতে হতো না! আম্মা আমার কষ্টটা বোঝে। ২৪ বছর একই ডায়ালগ শুনে শুনে ঘর ছেড়ে আসি। এখন কাজে বসে লিখছি, কিন্তু বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে! লিখতে পারছি না...!

ছবি: লেখক

বিমানবন্দরে বসে কিছু বন্ধুকে এসএমএস দিই। প্লেনে বসে একধরনের ঘোরের মধ্যে চলে যাই। চুপ করে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকি। ভাবটা এমন যেন সত্যিকারের প্রাণটা এখানে রেখে গেলাম। দেহ বয়ে নিয়ে চললাম...অনেক দিন দেশ ছাড়া! আহা রে কষ্ট...