জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য সমস্যা

বিশুদ্ধ বাতাস, স্বচ্ছ ও নিরাপদ পানীয় জল, পর্যাপ্ত খাদ্য এবং নিরাপদ বাসস্থান ও স্বাস্থ্য-এই মৌলিক চাহিদাগুলোকে প্রভাবিত করছে জলবায়ু পরিবর্তন। সাম্প্রতিক অতীতে বছরে অতিরিক্ত ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে শুধুমাত্র বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে। জলবায়ু ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত ও সংবেদনশীল স্বাস্থ্য-সমস্যাগুলো, যেমন-অপুষ্টি, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু ইত্যাদি ভয়াবহ আকার নিতে চলেছে। আগে পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে ভৌগোলিক কারণে এগুলোর প্রকোপ ছিল না বা কম ছিল। জলবায়ু পরিবর্তন সেই অঞ্চলগুলোতে ভৌগোলিক সীমারেখা মুছে নতুন স্বাস্থ্য-সমস্যা সৃষ্টি করছে। বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশের দুর্বল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এই সমস্যার আকস্মিকতা ও ব্যাপ্তি সামলানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। পরিবেশকে শীতল ও নির্মল করার সব উদ্যোগের পাশাপাশি উন্নততর যাতায়াত, খাদ্য ও জ্বালানি ব্যবহার স্বাস্থ্য-সমস্যার এই নতুন দিকটি সামাল দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হচ্ছে।

সমস্যার মূলে যে জলবায়ু পরিবর্তন, তা কীভাবে এমন মাত্রায় পৌঁছাল? গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের পরিবেশবিরোধী নানা রকম ক্রিয়াকলাপের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন, মিথেন, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর উপস্থিতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বায়ুমণ্ডলের নিচের স্তরে উষ্ণতা বেড়ে গিয়ে তা প্রভাবিত করছে পৃথিবীর জলবায়ুকে। বিভিন্ন অঞ্চলে বদলে যাচ্ছে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি, পরিমাণ এমনকি ঋতুছন্দও। গত ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর উষ্ণতা প্রতি দশকে প্রায় দশমিক ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বেড়ে চলেছে। গলে যাচ্ছে হিমবাহ ও মেরু প্রদেশের বরফ। সমুদ্রতলের উচ্চতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

প্রসঙ্গত, এশিয়া অঞ্চলের সমুদ্রতল ৪০ সেন্টিমিটারের বেশি বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। ঠান্ডা বা গরমের তীব্রতা লক্ষণীয়ভাবে স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানা রকমের স্বাস্থ্যসমস্যা ডেকে আনছে। যেমন, তীব্র গরমে কার্ডিওভাসকুলার ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বাড়ছে, যা মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে। বিশেষত বয়স্করা এর শিকার হচ্ছে বেশি। উচ্চ তাপমাত্রা এবং বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এই ধরনের দূষিত আবহাওয়া শহরাঞ্চলে অ্যাজমার প্রকোপ বৃদ্ধি করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে গত অর্ধ-শতাব্দীতে আবহাওয়া-সংক্রান্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শঙ্কা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। প্রচলিত চিকিৎসা ও পরিকাঠামো এটি মোকাবিলা করতে পারছে না। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা। পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সমুদ্রের কাছাকাছি বাস করে। ফলে এক বিরাট জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এই ঝুঁকি এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে—যাদের এরই মধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের সংকট।

বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি ক্রমাগত বদলে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট এরই মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে। পুকুর, খাল-বিল, নদী-নালা ইত্যাদির পানির অন্যতম উৎস বৃষ্টি। এগুলো আবার কৃষিকাজের জন্য অপরিহার্য সেচের অন্যতম উৎস। তাই বিশুদ্ধ পানির অভাবের এক বিরাট নেতিবাচক প্রভাব আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। এরই মধ্যে ডায়রিয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ রোগে প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ মানুষ মারা যায়। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খরা ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি। মনে করা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৯০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে খরায় আক্রান্ত এলাকা ব্যাপকভাবে বাড়বে। খরার ঝুঁকি বেড়ে যাবে দুগুণ। আর খরার গড় সময়কাল বেড়ে ছয় গুণে দাঁড়াবে। একইভাবে বাড়বে বন্যার সংখ্যা ও ভয়াবহতাও। ফলে পানিবাহিত রোগসহ নানা ধরনের সংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়ে যাবে। আর বন্যার প্রত্যক্ষ ক্ষতি হিসেবে জীবন ও সম্পদহানি তো রয়েছেই।

সব থেকে বড় কথা হলো তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের প্রভাবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন যথেষ্ট কমে যাবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ২০২০ সালের মধ্যে আফ্রিকার অনেক পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে উৎপাদন ৫০ শতাংশ হ্রাস পাবে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমলে সার্বিকভাবে বাড়বে অপুষ্টি, যাতে এখনই বছরে প্রায় ৩৫ লাখ লোক মারা যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এরই মধ্যে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তন নানা কীটপতঙ্গের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। শামুক প্রজাতির প্রাণী ও বিভিন্ন শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণীর মাধ্যমে সাধারণভাবে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ হয়। পরিবর্তিত জলবায়ু এ ধরনের প্রাণীর মাধ্যমে রোগের জীবাণু সংক্রমণের কাল দীর্ঘায়িত করছে। চীনে শামুকজাতীয় প্রাণীবাহিত সিস্টোসোমিয়াসিস রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। সারা পৃথিবীতে অ্যানোফিলিস মশাবাহিত ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু দ্রুত ছড়াচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০২২ সালের মধ্যে আরও অতিরিক্ত ২০০ কোটি মানুষের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি রোগের প্রকোপ বাড়ছে। উচ্চ তাপমাত্রায় অনেক সময় কলেরার মতো ব্যাকটেরিয়াবাহিত রোগ মহামারির আকার নিতে পারে। একইভাবে বেড়ে যেতে পারে অ্যানিফিলিস মশাবাহিত ম্যালেরিয়া। কিউলেক্স মশাবাহিত জাপানি এনসেফেলইটিসের বাড়-বাড়ন্ত লক্ষ্য করা যায় বর্ষার আবহাওয়ায়, যখন বেশি বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি তাপমাত্রা অন্তত ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়।

এই যখন অবস্থা, তখন জলবায়ু পরিবর্তনের কার্য-কারণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞেরা এখনো দ্বিধাবিভক্ত। একপক্ষ মনে করেন, মানুষের ক্রিয়া-কলাপের ফলেই এই অবাঞ্ছিত পরিবর্তন। অন্য দল মনে করেন, পৃথিবীতে মানুষ আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই প্রাকৃতিকভাবেই কখনো পৃথিবী উষ্ণ হয়েছে, কখনোবা শীতল। তবে কারণ যা-ই হোক না কেন, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্যতা এবং তার ফলস্বরূপ নানা ধরনের স্বাস্থ্য-সমস্যা ক্রমশ একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে এই মুহূর্তে করণীয় কী? প্রাথমিকভাবে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্য খাতে সৃষ্ট নতুন নতুন সমস্যার মধ্যে সম্পর্কবিষয়ক আমাদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করা দরকার। তারপর স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাববিষয়ক একটি নির্দেশিকা তৈরি করা জরুরি, যেখানে রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রক্রিয়াটিকে সার্বিকভাবে তুলে ধরা হবে। প্রশাসন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এ ক্ষেত্রে সমভাবে উন্নত করতে হবে। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া ও এ থেকে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর পরিকল্পনাগুলোকে আরও সুদৃঢ় করতে হবে। একই সঙ্গে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণের উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় বিশেষীকরণ এবং পরিবেশনীতি ও স্বাস্থ্যনীতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

মনে রাখতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য-সমস্যা যেমন একটি আঞ্চলিক ইস্যু, তেমনি এটি বৈশ্বিক ইস্যুও। কারণ, শেষমেশ ‘প্রকৃতি’ গোটা বিষয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই পৃথিবীর সব দেশ, সব সরকারকে অন্তত এই একটি বিষয়ে এক হয়েই কাজ করতে হবে। না-হলে সমস্যাটির মূলে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। তবে বাংলাদেশের মতো একই সঙ্গে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় ও জনবহুল দেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যসমস্যা বিষয়ে উপযুক্ত গণ-সচেতনতা সবার আগে প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো নিঃসন্দেহে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। আমাদের দেশ ছোট। জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। কাজেই জনভারে আমরা জর্জরিত। আমরা যে যেখানেই থাকি, যেভাবেই থাকি, যে অবস্থানেই থাকি না কেন, আমাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে-যার ওপর আগামী দিনে দেশের জনস্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করবে।