চেরিগাছে ঘেরা পার্কের শহরে

ছবি: লেখক

আমি পড়াশোনার জন্য রয়েছি অস্ট্রিয়ার ইন্সব্রুক শহরে। শহরটি ছোট হলেও অনেক সুন্দর। এটি অস্ট্রিয়ার টিরল জেলায়। টিরলের একদিকে জার্মানি, একদিকে সুইজারল্যান্ড আর অন্যদিকে ইতালি; আরেক দিকে রয়েছে অস্ট্রিয়ার বাকি অংশ। দেশটি ইউরোপের ঠিক মাঝখানে আল্পস পর্বতে ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত।

অন্য ধর্মের লোক হলেও দেশে থাকতে পবিত্র রোজায় বন্ধুদের সঙ্গে ইফতারে অংশ নিতাম। ঈদে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতাম। অস্ট্রিয়ায় আমি একটি ফ্ল্যাটে একটি রুমে একা থাকি। পরিচিত বিদেশি রোজাদার কেউ কাছে থাকেন না। যে ফ্ল্যাটে থাকি, সেখানে অন্য তিনজনের মধ্যে একজন ইতালির, একজন গ্রিসের এবং একজন হাঙ্গেরির। তাঁরা খ্রিষ্টান। তাই এখানে রোজার আমেজটা পাই না।

এরপরও এখানে আসার পর একটা জিনিস মিল পেলাম স্বদেশের সঙ্গে। পবিত্র রমজান মাস আর ইস্টার হলিডে প্রায় একই সঙ্গে শুরু। এ সময় দুই সপ্তাহ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে। তাই রোজাদার ছাত্রদের জন্য রোজা পালনে কিছুটা সুবিধা হয়, সেটি বুঝেছি। এখানে আবার পড়াশোনা খুব কঠিন। তাই অবহেলা করা যায় না। পড়াশোনা অগ্রগতি দেখিয়ে প্রতিবছর ভিসা রিনিউ করতে হয়। তাই রোজা বা ঈদ নিয়ে এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।

ছবি: লেখক

আমি ইস্টারের বন্ধে কয়েকটি জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি। এর মধ্যে একটি হলো সোভারফস্কি (বানান Swarovski হলেও এখানে W–কে ‘ভি’ বলে আর V–কে বলে ‘ফাউ’। যেটির উচ্চারণ এফের মতো) ক্রিস্টাল মিউজিয়াম। যেখানে শুটিং হয়েছে হলিউড সিনেমার। মিউজিয়ামের বাইরের পরিবেশ বেশ সুন্দর। বিস্তীর্ণ সবুজ–সমতল মাঠ ও ফুলের বাগান। সঙ্গে নীল পানির ফোয়ারা। এখানকার মূল আকর্ষণ হচ্ছে কৃত্রিম বিশাল একটি মুখমণ্ডল দিয়ে অনবরত পরিষ্কার পানি ঝরে পড়া। মিউজিয়ামের ভেতরে ঢুকতে হলে টিকিট নিতে হবে ১৯ ইউরো দিয়ে। ভেতরে অন্য রকম পরিবেশ। সবকিছু কাচ দিয়ে তৈরি। ভেতরে রক্ষিত রয়েছে বিভিন্ন রাজা-রানির ব্যবহৃত অলংকার। আরও অনেক কিছু তো রয়েছেই।

যেহেতু পড়াশোনায় রয়েছি, তাই এ দেশের পড়াশোনার ধরন নিয়ে কিছু বলি। আমি ইউনিভার্সিটি অব ইন্সব্রুকে পড়ছি কম্পিউটার সায়েন্সে, স্নাতকোত্তরে। দেশ থেকে ভর্তির হওয়ার সময় বলা হয়েছিল প্রতি সেমিস্টারে ৭২০ ইউরো করে দিতে হবে। কিন্তু এখানে আসার পর জানলাম, প্রতি সেমিস্টারে দিতে হবে শুধু ২০ ইউরো। এটা কেন? অস্ট্রিয়া সরকার তাদের কাছ থেকে এই পরিমাণ টাকাই নেয়, যাঁরা গরিব রাষ্ট্র থেকে পড়তে আসেন। বিষয়টি খুব ভালো লেগেছে। পরে বুঝলাম, এরা পড়াশোনার বিষয়ে খুব সিরিয়াস।

ছবি: লেখক

এখানকার কোনো ছাত্রছাত্রী যখন স্কুল শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য তৈরি হয়, তখন নির্ধারণ হয়ে যায় সে কী বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। মূলত এখানে টেকনোলজিক্যাল বিষয়, যেমন প্রকৌশল বা মেডিকেলে সেসব শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে পড়তে দেওয়া হয়, যাদের বিদ্যালয়ের ফল খুব ভালো। এর বাইরে যারা প্রকৌশল বা মেডিকেলের মতো ভালো বিষয়ে পড়তে চায়, তাদের অনেক টাকা খরচ করতে হয়।

গণপরিবহন পরিচালনা করতে এখানে প্রাইভেট কোনো কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় না। সব সরকারের হাতে। তাই যে কেউ রাস্তায় বড় গাড়ি নামাতে পারে না। বাস, ট্রাম, ট্রেনগুলো অনেক উন্নত। যোগাযোগব্যবস্থা খুবই ভালো। শারীরিক প্রতিবন্ধী যে কেউ কারও সহযোগিতা ছাড়া অনায়াসে চলাফেরা করতে পারবে যেখানে ইচ্ছা সেখানে। যানবাহনেও উঠতে তাদের কষ্ট হয় না। রাস্তাঘাটগুলো সেভাবে তৈরি। এখানে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া এত সহজ নয়। অনেক পরীক্ষা দিতে হয়। লাইসেন্স পেলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে গাড়ি চালালে লাইসেন্স বাতিল। সবাই শতভাগ ট্রাফিক আইন মেনে চলেন। তাই এ শহরে ট্রাফিক জ্যাম চোখে পড়েনি।

আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। এখানে আপনি যেখানেই যাবেন, সবুজ ঘাস আর চেরিগাছে ঘেরা পার্ক পাবেনই। পার্কে নারী-পুরুষ সবাই অবসরে হাঁটতে আসেন, কেউ ব্যায়াম করতে আসেন। কেউ চালান সাইকেল। এখানে ব্যায়ামের পোশাক পরে সাইকেল চালানো আর দৌড়ানো বেশি চোখে পড়ে। শিশু ও বয়স্করাও এসবে পিছিয়ে নেই।

বসন্তের এই সময়ে চেরি ফুলগুলো এমনভাবে ফোটে, তাতে যে কারও মন কাড়বেই।

আমি যে বাসায় থাকি, তার ১০ কিলোমিটারে মতো দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল আল্পস পর্বতের একটি অংশ। জানালা দিয়ে সকাল–বিকেল আল্পস পর্বত চোখে পড়ে। আসলেই দেখার মতো একটি দেশ।