
একটা পরিস্থিতি কল্পনা করুন। ধরুন রাস্তায় হঠাৎ কারও সঙ্গে আপনার আলাপ-পরিচয় হলো। তাকে কি আপনি বাসায় নিয়ে আসবেন? তার সঙ্গে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে তাকে আপনার জীবনের ব্যক্তিগত গল্প শোনাবেন, যা একান্তই আপনজনকে বলা যায়? অথবা তাকে সারা ঘর ঘুরে ঘুরে দেখাবেন, কিচেন, ডাইনিং, বেডরুম? কিংবা তাকে আলমারি থেকে ফ্যামিলি ফটো অ্যালবামটা নামিয়ে ছবি দেখাবেন বিয়ের ছবি, বউ-বাচ্চা, মা-বাবার ছবি? খুব সম্ভবত না!
বাস্তবে কিন্তু ব্যাপারখানা এমনটিই ঘটছে অনেকের ক্ষেত্রে। শুধু অনলাইনে ঘটছে বলে ব্যাপারটির গুরুত্ব ও ক্ষতির মাত্রাটা ঠিক তুলনা করতে পারছি না। এই মাত্রাটা বুঝতে হলে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি। ধরা যাক সোশ্যাল মিডিয়ার কথাই। আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে এমন কেউ কি আছেন যাকে আপনি আসলেই চেনেন না? কিংবা নিজের চোখে যাকে কখনো দেখেননি? কিংবা কোনো সোশ্যাল এসব সাইটে আপনি কি কোনো ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করছেন, যা শেয়ার করার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, যেমন ই-মেইল (ব্যক্তিগত), টেলিফোন নম্বর, ঠিকানা, পেশা ইত্যাদি? প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে ওপরের পরিস্থিতির উত্তরও আপনার ক্ষেত্রে হ্যাঁ হওয়া উচিত, যা স্বভাবতই আপনার কাম্য নয়। তথাপি এর কারণ কী হতে পারে, কেনই বা আমরা সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার নামে অনলাইনে নিজেদের প্রাইভেসি ধ্বংস করে চলেছি? খুব সম্ভবত এর কারণ হলো, বাস্তব জীবনে আপনি যতটা সচেতন, অনলাইনে আপনি সচেতন থাকেন না। ইন্টারনেট আপনার কাছে কল্পনার ফানুসের মতো। এই আছে এই নাই। রাস্তায় চলার পথে অপরিচিত কাউকে বন্ধু না বানালেও অনলাইনে বোতাম টিপে বন্ধু বানাতে আপনার আপত্তি নেই। আবার কেউ যদি আপনার নামধাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করে, আপনি একটু বিরক্ত হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই এসব অকাতরে শেয়ার করে থাকেন। অপরিচিত কাউকে ঘরে এনে মা-বাবা-স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আপনার আপত্তি থাকলেও, মিডিয়ায় ফ্যামিলি ছবি পাবলিকলি আপলোড করতে আপনার আপত্তি নেই।
সবচেয়ে বড় কারণ হলো, আপনি এখনো সাইবার ক্রাইমের শিকার হননি। সাইবার ক্রাইম আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনো তেমন ব্যাপকতা পায়নি। তবে সামাজিক অবক্ষয় বা অন্য যেকোনো কারণে ব্যক্তিগত লেভেলে সাইবার ক্রাইমের কিছু ঘটনা ঘটছে অহরহ। যেমন কারও ব্যক্তিগত ছবি বা তথ্য নোংরাভাবে উপস্থাপন করে হেয় করা, ব্ল্যাকমেইল করা বা আত্মহত্যার মতো ঘটনা পত্রিকায় মাঝে মাঝেই দেখি। এসব তথ্য বা ছবি সাধারণত সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নেয়া, যা অপরাধীদের জন্য অনেক সহজ। কারণ ভিকটিম নিজেই অপরাধীদের কাজ সহজ করে দেয়। এসব অপরাধের পেছনে মনস্তাত্ত্বিক কিছু বিষয় মূলত কাজ করে। ব্যক্তিগত ক্ষোভ, হতাশা, পারিবারিক অশান্তি, প্রেমে ব্যর্থতা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখযোগ্য। তবে একবার ভাবুন, এসব কারণ ছাড়াও অপরাধী হয়তো ততটা এগ্রেসিভ হতো না, যদি না তথ্য/ছবি সরবরাহ করে তাকে প্রলুব্ধ করা হতো। ভিকটিম নিজে সরাসরি না হলেও অন্য কেউ হয়তো তাকে এ ক্ষেত্রে প্রলুব্ধ করতে পারে। এটাকে বলা হয় ‘ইনসাইটমেন্ট’ বা উদ্দীপনা বা প্ররোচনা, যা ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলশের কমন ল অনুযায়ী একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। (Jefferson, Michael. Criminal Law. Eighth Edition. Pearson Education.2007. )
দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, অনলাইন সুবিধা ব্যবহারকারীরা শিক্ষিত হয়েও প্রাইভেসির ব্যাপারটাকে বেশ হালকাভাবেই দেখেন। আবার অনেকে ব্যাপারটা তেমন ভালো জানেন না। তারা হয়তো জানেনই না, মোবাইল দিয়ে তোলা একটা ফটো ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, গুগল ইত্যাদি কত কত জায়গায় না চলে যাচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রত্যেকের নিজস্ব ক্লাউড সার্ভার রয়েছে যা আপনার ছবিটা আলাদাভাবে জমা করছে, যাকে বলা হয়ে থাকে ডেটা ফ্রেগমেন্টেশন। সম্প্রতি ইউটিউবে একটা ভিডিও বেশ আলোড়ন তোলে ৷ যেখানে দেখা যায় শুধু নাম জানা থাকলেই কারও ব্যক্তিগত সব তথ্য জেনে নেয়া যাচ্ছে। আর এটা করা হচ্ছে টার্গেট ব্যক্তির নামে সব সোশ্যাল মিডিয়া চেক করে। আর এভাবে বিভিন্ন সময় তোলা ছবি, ভিডিও, স্ট্যাটাস, কমেন্ট ইত্যাদি পড়ে খুব সহজেই তার নামধাম-পেশা, পছন্দ-অপছন্দ, শখ, পারিবারিক সম্পর্ক ইত্যাদি জেনে নেয়া যায়। আপনি নিজেই এটা পরীক্ষা করতে পারেন আপনার নিজের ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার ইত্যাদি চেক করে। এসব নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডারের প্রাইভেসি পলিসিও আলাদা, যা না পড়েই আমরা সাধারণত এগ্রি করি। এসব মিডিয়ার অনেকের সঙ্গেই রয়েছে থার্ড পার্টি এগ্রিমেন্ট, যার কারণে আপনার তথ্য ব্যবসায়িক কারণে অন্য কোনো কোম্পানি কর্তৃক ব্যবহৃত হতে পারবে আপনার অজান্তে। এর আইনি বৈধতাও আপনি দিয়েছেন ‘আই এগ্রি’ লেখা কোনার ছোট্ট বক্সটাতে ক্লিক করে। প্রাইভেসি এগ্রিমেন্টগুলোর ইউজার এবং সার্ভিস প্রোভাইডার পর্যায়ের এই দ্বন্দ্ব নিয়ে চমৎকার আর্টিকেলটি পড়তে পারেন Home is safer than the cloud: privacy concerns for consumer cloud storage. (Ion, I. , Sachdeva, N. , Kumaraguru, P.
অনেকেই বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপস যেমন গেমস ইত্যাদি থার্ড পার্টি সফটওয়ার ব্যবহার করেন। এসব ফ্রি অ্যাপস চলে কীভাবে, একবারও ভেবেছেন? এরা চলে আপনার তথ্য বেচে। এসব অ্যাপস মোবাইলে ডাউনলোড করার সময় শর্ত হিসেবে আপনার ব্যক্তিগত তথ্যে প্রবেশাধিকার চায়, এমনকি আপনার হয়ে পোস্ট করার অধিকার চায়। অন্যের হয়ে পোস্ট করাটা অদ্ভুত শোনালেও এটা খুবই কমন ঘটনা। শুধু পোস্টই নয়, এরা আপনার ফ্রেন্ডলিস্টের সবাইকেই ঘন ঘন রিকোয়েস্ট সেন্ড করে (আপনার অজান্তে), যা খুবই বিরক্তিকর। তাই অপ্রয়োজনীয় এসব অ্যাপস, গেমস না রাখাই ভালো। আবার এমন অনেক অ্যাপস হয়তো আপনার অ্যাকাউন্টের সঙ্গে লিংক করা আছে, যা আপনি জানেনই না। কোনো এক সময় এগ্রি করেছিলেন, এখন ব্যবহার করছেন না। আপনি জানেন না কারণ, মোবাইল অ্যাপসগুলো দেখা গেলেও ফেসবুক বা অন্যান্য মিডিয়ার ওয়েব অ্যাপস দেখা কষ্টসাধ্য। আপনি সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবপেইজের সেটিংসে গিয়ে এসব অব্যবহৃত অ্যাপ রিমুভ করে দিতে পারেন।
অনলাইন মিডিয়ার ক্রাইমগুলো বেশির ভাগেরই কারণ ভিকটিমের অসচেতনতা। ইদানীং মোবাইল ফোন মানেই ছবির বন্যা। শুধু যে সেলফি, তা নয়। বন্ধুদের আড্ডায় হয়তো স্বল্পপরিচিত কেউ আপনার গ্রুপ ছবি উঠিয়ে নিল। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুকসহ নানা জায়গায় চলে গেল সম্পূর্ণ আপনার অজান্তে। তাই ছবি তোলার ক্ষেত্রে সচেতন হোন। অপরিচিত কারও ছবি তুলতে চাইলে অনুমতি অবশ্যই নিতে হবে, এই ভদ্রতা জ্ঞানটুকু অনেকেরই নেই। আর নিজে কোনো ছবি আপলোড করতে চাইলে প্রাইভেসি সেটিংস ভালোভাবে চেক করে নিন। সাধারণত হাই কোয়ালিটির ছবি এডিটিং করা সহজ। তাই ছবির রেজ্যুলেশন কমিয়ে পোস্ট করতে পারেন। ছবির কোয়ালিটি কমানোর জন্য বিভিন্ন সফটওয়ার পাওয়া যায়, যা ব্যবহার করতে পারেন। এসব ছবি বিকৃত করা কঠিন বা করলেও তা সহজেই বোঝা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ‘হোম ইজ সেফার দ্যান ক্লাউড’-অপ্রয়োজনে শুধু ফান মনে করে যত্রতত্র ছবিসহ তথ্য আপলোডে সতর্কতা জরুরি।
ইন্টারনেট আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে সহজ করলেও ব্যক্তিগত জীবনে অনেক দুর্ঘটনারও জন্ম দিতে পারে। তাই আগেই সচেতন হওয়া জরুরি। নইলে কি-প্যাড বাটনের একটা ক্লিক হয়তো সারা জীবনের দুঃসহ স্মৃতির কারণ হতে পারে।
(লিয়াকত হাসান, শিক্ষার্থী, কমপিউটার সায়েন্স ইন সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট)