অটো-কাহিনি–১
১.
কাচের দেয়ালঘেরা মিউনিখ শহরটা দূরে অধোবদনে দাঁড়িয়ে। নিশ্ছিদ্র ফোঁকর গলে লোকগুলো চম্পট দিচ্ছে, ব্যাপারটা তার ঠিক ভালো লাগছে না। তাই বোধ হয় আস্ত একখণ্ড কালো মেঘ পাঠিয়ে দিয়েছে। যেটা কিনা পিছু নিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। কিন্তু হাইওয়েতে উঠে আমাদের আর পায় কে। পেডাল চেপে প্রায় তিরের গতিতে ধূলা উড়িয়ে, গাড়ি হাঁকিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি।
শুক্রবারটা ছুটি নিয়ে দুই দিনের, শনি-রবিকে টেনেটুনে তিন দিনের মামলা বানিয়ে ছুটে চলছি স্টুটগার্ট বরাবর। মিউনিখের কালো মেঘকে কচু দেখাতে তাই বাধছে না কোথাও। তা ছাড়া উঁচু-নিচু পাহাড়ি শহর স্টুটগার্টের আবেদনটা বেশ গাঢ়। সেখানে এক বন্ধু দম্পতি খিচুড়ি আর গরুর মাংস চুলায় চাপিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ধোঁয়া ওঠা খাবারের ঘ্রাণ আমাদের ‘আয় খুকু, আয়’ সুরে ডাকছে। সে ডাক উপেক্ষা করে সাধ্য কার। তাই চার ঘণ্টা ঠেঙ্গিয়ে মিউনিখ-টু-স্টুটগার্ট যাত্রাটা অত মন্দ লাগছে না। যাত্রা শেষে প্রাপ্তির পুরোটা পেটে চালান করে দিব।
খাদ্যচিন্তায় মগ্ন হয়ে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়েছি। খিচুড়ির সঙ্গে বোনাস হিসেবে বেগুন ভাজা থাকবে কি থাকবে না—এই তরল চিন্তার বায়বীয় বুদ্বুদ থেকে বের হতে পারছি না। সঙ্গে যদি টকটকে লাল টমেটোর ভেতর থেকে সবুজ কাঁচামরিচ আর হালকা গোলাপি পেঁয়াজকুচিরা উঁকিঝুঁকি মারে, তাহলে তো আর কথাই নেই। সরিষার তেলের ঝাঁজ নাকে এসে সপাটে আঘাত হেনে গেল যেন। হাতে স্টিয়ারিং থাকলে এতক্ষণে বে-লাইনে গাড়ি চালিয়ে দিতাম নির্ঘাত।
বাঙালির হেঁশেল থেকে লোভাতুর মনটা বাঁকিয়ে–চুরিয়ে বের করে এবার জার্মান অটোবানে এনে ছুড়ে ফেললাম। যা–ই জার্মান ‘অটোবান’, তা–ই ইংরেজি হাইওয়ে আর সেটাই বাংলায় মহাসড়ক। তবে অটোবানের একটা আলাদা রোমাঞ্চ আছে। আর সেটা হল বেপরোয়া গতি। অটোবানের অনেক পথেই গতিসীমার মাত্রা নেই। হাঁকাও গাড়ি, যত খুশি হেঁইয়ো। আর ডানে-বাঁয়ে ঘটছেও তা–ই। পাগলাটে গাড়িগুলো শাঁই শাঁই প্রায় উড়ে যাচ্ছে যেন। ঘণ্টায় দু শো কিলোমিটার বেগে আমরাও চলছি। কিন্তু তৃপ্তি মেলার আগেই পাশ ঘেষে লাল ফেরারিটা ধূমকেতুর মতো মিলিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দিল, গতির খেলায় তার কাছে আমাদের সেকেন্ড হ্যান্ড কালো ভক্সওয়াগন এক বুড়ো কচ্ছপবিশেষ।
বুড়ো কাছিমের পিঠেই না হয় পাড়ি দিলাম পথ। পেছনের সিটে ছয় বছরের ছেলেটা ঘুমে ঢুলুঢুলু। স্বছ লালার একটা স্রোত একবার গড়িয়ে নামছে তো আবার সুড়ুৎ করে ঠোঁটের ফাঁকে উল্টোরথ ধরছে। ছেলের বাবার সেই আয়েশের জো নেই। তাকে তীক্ষ্ণ চোখে, শক্ত হাতে গাড়ির হাল ধরে বসে থাকতে হচ্ছে। একমাত্র আমারই কাজ নেই। নিজেকে বিরাট কাছিমের পেটের অলস ডিম বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য আলসেমিতে আগ্রহ ষোলো আনা। সঙ্গে করে ব্যবস্থাপাতিও কম আনিনি। সিটের নিচ থেকে কোল্ড কফির ক্যান বের করলাম ব্যাগ হাতড়ে। ঠান্ডা চুমুকে চারপাশটা দেখছি তাড়িয়ে তাড়িয়ে। শীতল আবেশের আয়েশি আবেগে চোখ বুজে আসছে প্রায়।
জানালার বাইরে ভুট্টাখেতের সারি। তারা যেন বাধ্য সেনাদলের মতো মাথা নুইয়ে আছে। গাড়ির কুচকাওয়াজ সরে গেলে আবার আরামে দাঁড়াবে সটান। আকাশটাও আজ দেখার মতন। এখানে–ওখানে মেঘদল। কিছুটা হতবিহ্বল। বৃষ্টি হয়ে নামবে, নাকি নীরবে সরে গিয়ে এক আকাশ রোদকে জায়গা করে দেবে—এ নিয়ে যেন বিরাট দ্বিধায় আছে। সেই সুযোগে দুষ্টু সূর্যটা মিষ্টি হাসছে ফাঁক পেলেই। দূরের শুভ্র উইন্ডমিলগুলো আস্তে আস্তে ঘুরে চলছে আপন মনে। তাদের স্পিনিং দরবেশ বলে ভুল হতে চায়। উইন্ডমিল নয়, যেন সাদা আলখাল্লা জড়িয়ে তুর্কি সুফির দল চক্রাকারে ঘুরছে উদ্বাহু। আকাশে মেঘ-রোদের লুকোচুরি, অটোবানে গাড়ি–ঘোড়ার উন্মাদনা—কোনো কিছুই স্পর্শ করছে না তাদের। দশ দিগন্তের মাঝে দাঁড়িয়ে ঘূর্ণিধ্যানে মগ্ন, নির্বিকার, নির্নিমেষ।
মোক্ষ লাভের নেশাটা পেয়ে বসেছিল। যদি না অতর্কিতে গাড়ির গতি কমে এসে ঝাঁকুনি না লাগাত। হালকাপাতলা একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে মনে হচ্ছে। গাড়ির সারিগুলো হ্যাজার্ড বাতি জ্বালিয়ে আগাম জানান দিচ্ছে, ‘সামনে সাবধান’।
অটোবানের দুর্ঘটনা অবশ্য হালকাপাতলা হয় না। মোটাসোটা কিসিমেরই হয়। তীব্র গতির দুটি ধাতব যন্ত্র একে অন্যকে সামান্য ছুঁয়ে গেলেও ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস’ কায়দায় উল্টে গিয়ে পাকের পর পাক খেয়ে কোন দূরে পড়বে গোত্তা লেগে, কে জানে। তেমন হলে ভেতরে আটক যাত্রী যন্ত্রযান থেকে একলাফে স্বর্গযানে উঠে পড়েন আর কি। অটোবানের অভিধানে মাঝামাঝি বলে কিছু নেই, ‘হেল অর হাইওয়ে’।
কপাল ভালো। দোমড়ানো গাড়ি, ভাঙাচোরা যাত্রী আর প্যাঁ-পোঁ অ্যাম্বুলেন্স দেখতে হলো না। বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা নিরীহ চেহারার পোর্শে কনভার্টিবলকে তুলতে বিশালাকার রেস্কিউ ট্রাক এসেছে। টেনে তোলার তোড়জোড় চলছে। আর তাতেই শ খানেক গাড়ির স্রোত থমকে গেছে হঠাৎ। চলবে...
লেখক: ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার, গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি