বিশ্বকাপ ফুটবল ও বাঙালির উন্মাদনা

মেসি ও নেইমার
ছবি: রয়টার্স

প্রতি চার বছর পর বিশ্বব্যাপী ফুটবলের জোয়ার নিয়ে আসে বিশ্বকাপ ফুটবল। সেই জোয়ারের রেশ ছড়িয়ে পড়ে এ বাংলায়। খেলাপাগল জাতি হচ্ছে বাঙালি। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে সেই আনন্দের পালে নতুন হাওয়া লাগে বাঙালির উন্মাদনায়। পুরো বাংলাদেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা দুই দলে ভাগ হয়ে যায়। চায়ের কাপ থেকে যেকোনো ময়দানের আড্ডার মূল বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় প্রিয় দলের জয়–পরাজয়ের হিসাব–নিকাশ ও বিশ্লেষণ।

দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ নামে পরিচিত এ প্রতিযোগিতা বৈশ্বিক মানদণ্ডে উঁচু মানে অবস্থান করছে। ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল উরুগুয়েতে আয়োজিত হলেও বাঙালিদের সঙ্গে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রকৃত সখ্য গড়ে ওঠে আরও পরে। যার ভিত্তিস্তর হচ্ছে ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল। প্রথমবার বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ সম্প্রচার করে। পরে ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনাল ম্যাচ সম্প্রচার করে। আর ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের সব ম্যাচ সম্প্রচার করার মধ্য দিয়ে বাঙালিদের সঙ্গে জৌলুশ ও সখ্যের নিবিড় বন্ধন গড়ে তোলে বিশ্বকাপ ফুটবল।

সময়ের পরিক্রমায় বাছাইপর্ব থেকে উত্তীর্ণ ৩২টি দেশের অংশগ্রহণে বিশ্বকাপ ফুটবলের ২২তম আসর শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ কাতারে ২০ নভেম্বর। এর সমাপ্তি ঘটবে ১৮ ডিসেম্বর ফাইনাল ম্যাচের মধ্য দিয়ে। ২০০২ সালে কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আরব বিশ্বে প্রথম ও এশিয়া মহাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবল। সাধারণত বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজিত হয় মে, জুন, জুলাই মাসে ফুটবল মৌসুম শেষ হওয়ার পর। তবে সে সময় অত্যধিক গরম ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কথা চিন্তা করে ফিফা নভেম্বর-ডিসেম্বরে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করে।

বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে ক্রীড়ামোদি মানুষদের এক বিন্দুতে মিলিত করার স্থল। সারা বছর কোনো খেলার খবর না রাখলেও বিশ্বকাপ ফুটবল এলেই সবাই ফুটবলীয় গবেষণায় মত্ত হয়ে যায়। পাড়া, মহল্লা, রাস্তাঘাট ছেয়ে যায় পছন্দের দলের পতাকায়।

কে কার চেয়ে বড় পতাকা লাগাবে, প্রিয় দলের সমর্থনে কোন জার্সি নেবে—এসব কর্মযজ্ঞে বিশ্বকাপ ফুটবল পায় পূর্ণ মাত্রা। আর বাঙালিদের পূর্ণ বিনোদনের খোরাকে পরিণত হয় বিশ্বকাপ ফুটবল। বিশ্বকাপ ফুটবল এমন একটি খেলা, যে খেলার দরুন প্রত্যেক মানুষের খেলার প্রতি যে নিবেদন ও আবেদন কাজ করে, তা সুনিপুণভাবে ফুটে ওঠে। বাঙালিরা তাদের চিত্তবিনোদন মেটানোর পাশাপাশি প্রিয় দলের বিজয়ে জয়োল্লাস করে, যাতে মিইয়ে যায় অনেক না জানা, অদেখা দুঃখ ও ভারাক্রান্ত প্রতিক্রিয়া।

বিশ্বকাপ ফুটবল চলবে প্রায় এক মাস। এ সময় বাঙালিরা বিশ্বকাপ আনন্দে বুঁদ হয়ে থাকে। সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার মেসি, রোনালদো, নেইমার, মদরিচ, সিলভা, হ্যারি কেইনসহ সেরা তারকাদের শৈল্পিক কারুকার্য ও মাঠের সবুজের ক্যানভাসে দৃষ্টিনন্দন সব গোল উৎসবে মাতোয়ারা হয় সাধারণ মানুষ। বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষের জন্য আয়োজিত বিজ্ঞাপন, যার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে খেলার বিনোদন দিয়ে সবাইকে এক সুতায় গাঁথা। তবে দিন শেষে মনে রাখতে হবে, এটি নিছক খেলা।

খেলাকে খেলার জায়গায় রাখাই বরং শ্রেয়। কারণ, প্রকৃতপক্ষে আমরা বাঙালিরা ঐতিহাসিকভাবে আবেগপ্রবণ। তাই বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রিয় দলের সমর্থনে যেকোনো তর্ক, মতভেদের বিপক্ষে গিয়ে কারও সঙ্গে সম্পর্কে যেন ব্যাঘাত না ঘটে, সে বিষয়ে বিশেষ সচেতন হতে হবে। তা ছাড়া বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে পুরো দেশে পতাকা টাঙানোর হিড়িক পড়ে। এ পতাকাগুলো টাঙানো বা খেলা শেষে সরিয়ে ফেলার সময় বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার ইত্যাদিতে না পেঁচিয়ে যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। না হলে পরে যেকোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, যার জন্য নিজেকে শুধু এই ক্ষতির ভার বহন করতে হবে। তাই খেলাকে খেলার স্থানে রেখে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ না হয়ে উপভোগ করুন বিশ্বকাপ ফুটবল, যাতে আচ্ছাদিত হোক দিন শেষে ক্লান্তির নিবারক হিসেবে।

*লেখক: শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান, শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়