মুজিব আমার বিজয়ের অমর কবি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

‘স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা…’। ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই…’। ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা…’। একটি ভালো কবিতা চিরন্তন। চিরকাল বেঁচে থাকে মানুষের মুখে মুখে।

তেমনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও একটি অমর কবিতা। এটি সর্বজনীন। বারবার কেবল শুনতে ইচ্ছে করে।

কোনো জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। পৃথিবীতে আর কি এমন একটি ভাষণও আছে, যার মধ্য দিয় একটি দেশের স্বাধীনতা এসেছে। ইতিহাসে স্মরণীয় ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ।

১৯৭১ সালের মার্চের শেষ দিকে শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। যুদ্ধের বছর ৫ এপ্রিল আমেরিকার বিশ্বখ্যাত সময়িকী ‘নিউজ উইক’ তাদের প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ বা ‘দ্য পয়েট অব পলিটিকস’ বলে অবিহিত করে।

কবিতা হলো জীবন ও প্রকৃতির শব্দগুলোর অপূর্ব বিন্যাস। সে শব্দগুলো হতে পারে প্রেমের, বেদনার, সংগ্রামের, যুদ্ধের, স্বাধীনতার, মানবতার, স্বপ্নের অথবা বেঁচে থাকার।

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্যই যেন অনিবার্য। এর প্রতিটি শব্দে লুকিয়ে আছে এ দেশের মানুষের স্বপ্ন, সংগ্রাম, যুদ্ধ, স্বাধীনতা, মানবতা, বেঁচে থাক। এ যেন বাঙালির অবিনাশী গান। প্রায় যেকোনো বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একটি অমর কবিতা। কোনো ভালো কবিতায় একটা শব্দও কম বা বেশি থাকে না। প্রতিটি শব্দকেই হতে হয় অবশ্যম্ভাবী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে যেন একটা কথাও কম-বেশি বলা হয়নি। একটা শব্দও ভুল বলা হয়নি। ১৮ মিনিটের এই ভাষণটি কোনো সাধারণ বক্তৃতা ছিল না। এটি ছিল স্বাধীনতার চেতনায় মগ্ন এক অবিসংবাদী নেতার হৃদয়নিংড়ানো অভিব্যক্তি। একটি অমর কবিতা।

আমাদের প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার প্রায় শুরুতেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে কবি বলেছেন। তিনি বলেছেনে, ‘কখন আসবে কবি’।

কবিতার একেবারে শেষে পঙক্তিতে লিখেছেন, ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন...’। একবার জাতীয় কবিতা পরিষদের শিরোনাম ছিল, কবি মুহাম্মদ সামাদের কবিতার পঙক্তি দিয়ে, ‘মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি।’

আহমদ ছফা লিখেছিলেন, ‘বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য চর্যাপদ নয়, বৈষ্ণব গীতিকা নয়, সোনার তরী কিংবা গীতাঞ্জলি কোনোটা নয়, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যগীতি হলো ‘আর দাবায় রাখতে পারবা না।’

জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ কারণ কবির মধ্যে বিগত কয়েক শতাব্দীর এবং সমকালের কবিতার ইতিহাসটা ক্রিয়া করে। সবার ভেতরে করে না। যারা কবি, কেবল তাদের মধ্যে করে। বঙ্গবন্ধু যখন ৭ মার্চের ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখনো যেন তাঁর মধ্যে এই জনপদের মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস ও সমকালের ইতিহাস ক্রিয়া করছিল। তিনি জানতেন, এ অঞ্চলের মানুষ কোনো দিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পায়নি। বঙ্গবন্ধু জীবনভর একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছেন।

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর কোনো নেতা প্রায় ১০ লাখ মানুষের সামনে এ রকম ভাষণ দিয়েছেন বলে জানা নেই। আজও তাঁর ভাষণ বেঁচে আছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে। থাকবে অনন্তকাল। এটা অমর কবিতা। এই কবিতার কবি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু।

৭ মার্চের ভাষণের সফল পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ। ৫০ বছরেও এই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি। পৃথিবীর অনেক ভাষায় এটি অনুবাদ হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকে এসেছে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ৭ মার্চ নিরন্তর এক অবিস্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে।

২০০৮ সালে বিবিসি বাংলার বিশ্বব্যাপী জরিপে বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন এমন কোনো পদক্ষেপ না নেন, যাতে ফিরে আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি হুমকি দেন যে মার্কিন সরকার পাকিস্তান ভাঙা সহ্য করবে না।

অন্যদিকে কীভাবে দেশের মানুষ আন্দোলন–সংগ্রামে চাঙা থাকবে, সেটিও বঙ্গবন্ধুকে ভাবতে হচ্ছে। এত সব ভয়ংকর চাপ ও জীবন-মরণ শঙ্কার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের তাৎক্ষণিক ও অলিখিত ভাষণটি ছিল বাঙালির স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা ও শ্রেষ্ঠ কাব্যগাথা।

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস, আন্দোলনের রূপরেখা, যুদ্ধের কৌশল, গরিবের কষ্ট, শত্রু বাহিনীর অনুপ্রেবেশ, সব সম্প্রদাকে সঙ্গে রাখা, সতর্ক থাকা—মাত্র ১৮ মিনিটে তিনি সব বললেন।

এদিকে কিছু দেশদ্রোহী ছাড়া সবাই অধীর আগ্রহে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার অপেক্ষা করছে। মার্চের শুরু থেকেই সারা দেশের পরিস্থিতি এমন পর্যায় ঠেকেছে, যে সবাই বঙ্গবন্ধু কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রত্যাশা করছে। এদিকে তরুণেরা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ফেলেছে। তিনি পাকিস্তানিদের এমন কোনো সুযোগ দিলেন না যে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে হত্যা, জুলুম ও নির্যাতন নেমে আসতে পারে। আবার স্বাধীনতার ঘোষণার থেকে কমও বললেন না। তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...।’

ভাষণের প্রায় শুরুতেই বলেছেন ‘২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর–নারীর আর্তনাদের ইতিহাস।’ এরপর তিনি কবিতার মতো পাঠ করতে থাকলেন ওই সময়ের প্রেক্ষাপট।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। কিন্তু পাকিস্তানের জেনারেল আর রাজনীতিকেরা গোপন বৈঠকে ঠিক করেছে নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করবে, তবু ক্ষমতা দেবে না। এদিকে বঙ্গবন্ধু/////////////////// স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে উৎফুল্ল জনতার মধ্যে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে ধরছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ২৩ মার্চ ১৯৭১

সমস্ত দায় দিয়ে দিলেন ইয়াহিয়াদের, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার মানুষকে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ একটিবারও আক্রমণ ও সহিংসতার কথা বলেননি। বরং বললেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।’ আবার বললেন ‘এই বাংলার হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-ননবেঙ্গলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি’...বললেন, ‘যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন...তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

সেদিন বঙ্গবন্ধুর তর্জনীতে ছিল বাংলার মানুষের গন্তব্যের নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেবে।’ এর চেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না৷

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের এক অনন্য মহিমা হলো এর সর্বজনীনতা ও মানবিকতা। বিশ্বের যেকোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে এই ভাষণ চিরকাল অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে।

কি নেই এ ভাষণে। গণতন্ত্র, মানবতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা সবই আছে। একটি পরাধীন জাতির হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষা এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। একজন মানুষ একটি অলিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন, যা একটি জাতির শত বছরের মনের কথা হয়ে রইল। বঙ্গবন্ধু আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসার জায়গা থেকে সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলেছেন।

বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ দেশের মানুষ যেন একটি লাল-সবুজের পতাকা বুকের মধ্যে নিয়ে চিৎকার করে বলতে পারে এটা আমার বাংলাদেশের পতাকা। পরাধীনতার শিকল ভেঙে আমরা এনেছি স্বাধীনতা। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু তাঁর জীনব উৎসর্গ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরে তোলা ছবি। (বাঁ থেকে) শেখ কামাল, শেখ রেহানা, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর কোলে শেখ রাসেল, বেগম মুজিব, শেখ জামাল ও শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীতে অনেক স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। অনেক আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে। আমাদের এক অকল্পনীয় সৌভাগ্য যে এই বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলতে চলতে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতা পেয়েছি। যিনি তাঁর সারা জীনব অত্যাচার–নির্যাতন সয়ে, জেলজুলুম খেটে সীমাহীন ত্যাগ, দেশপ্রেম আর প্রজ্ঞা দিয়ে আমাদের একটি স্বাধীনতা এনে দিলেন। দীর্য় ৯ মাস পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন।

১০ জানুয়ারি দেশে ফিরলেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো এক ঘোষণা দিলেন ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবরে। দিনটি ছিল বাঙালি জাতির আরকেটি ঐতিহাসিক অর্জনের দিন। এদিন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেসকো তার ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে।

এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালি জাতি এক অন্য উচ্চতায় চলে গেল। এটি প্রথম কোনো বাংলাদেশি দলিল, যা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্থান পেল। এর মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেল বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। এ ভাষণ নিয়ে এখন বিশ্বের দেশে দেশে গবেষণা হবে, আলোচনা হবে।

এটি এখন আর আমাদের একার নয়। এটা সারা পৃথিবীর অত্যাচারিত–নিপীড়িত মানুষের জীবনের কথা। প্রেরণারা চিরন্তন উৎস।


*লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক