সেন্ট মার্টিনের নাফ মোহনাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা কেন জরুরি

বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য আধার। এতে আছে বিপুলসংখ্যক মাছ, মোলাস্ক, প্রবাল, প্ল্যাঙ্কটন, শৈবালসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ। সমুদ্রের এসব সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। নির্বিচারে মৎস্য সম্পদ আহরণ, দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ এবং অসচেতনতার ফলে সাগরের বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে রয়েছে।

বাংলাদেশে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্যোগ বলতে মূলত মৎস্য ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বছরের বিভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি অবৈধ জাল ও সরঞ্জামাদি দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে।

তবে আইনের বিধান অনুসারে একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে সামুদ্রিক সুরক্ষিত এলাকা (এমপিএ) ঘোষণা করা প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের একটি সামগ্রিক ও আধুনিক ধারণা হিসেবে পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। এতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকায় জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণ, মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবিকায়নের জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সামুদ্রিক মেগাফনা, বিশেষ করে তিমি, ডলফিন, হাঙর এবং সামুদ্রিক কচ্ছপ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের ১৭ হাজার ৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম এমপিএ হিসেবে ঘোষণা করে।

পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সরকার ৩ হাজার ১৮৮ বর্গকিলোমিটার নিঝুম দ্বীপ এলাকাকে দ্বিতীয় এমপিএ হিসেবে ঘোষণা করে। দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল, নাফ নদীর মোহনা, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এবং মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন এলাকাগুলো সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য বিশেষ করে ম্যানগ্রোভ, প্রবাল ও নানা জাতের মৎস্য ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী প্রজাতির অন্যতম আবাসস্থল। পর্যটকদের মাত্রাতিরিক্ত চাপ, পরিবেশদূষণ ও জনসচেতনতার অভাবে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে রয়েছে। দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপটি ক্রমবর্ধমান হুমকির সম্মুখীন। জীববৈচিত্র্যের অন্যতম হটস্পট, বিস্তীর্ণ এ সামুদ্রিক অঞ্চলকে সংরক্ষণের জন্য অবিলম্বে অঞ্চলটিকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমন এবং মাদক পাচার বেড়ে যাওয়ায় সরকার ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নাফ নদী ও এর মোহনায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, যা নাফ মোহনায় ডলফিনসহ মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর বৃদ্ধি এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের একটি সুযোগ তৈরি করেছে। জীববিজ্ঞানীরাও অঞ্চলটিকে ‘ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পট’-এর অংশ বলে মনে করেন। এ কারণে এলাকাটি সংরক্ষণের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত বলে বিবেচিত হওয়ায় তা প্রস্তাবিত ‘নাফ-সেন্ট মার্টিন দ্বীপ’ এমপিএতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা দেশের জন্য একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে বিবেচিত হবে।

ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ ইউএসএআইডির অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন ইকোফিশ প্রকল্প-২-এর আওতায়, মৎস্য অধিদপ্তর, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইকোফিশের বিজ্ঞানীদের যৌথ উদ্যোগে, অঞ্চলটিকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য দুই বছর ধরে জুন ২০২১ পর্যন্ত একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

এ গবেষণায় পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশগত বাসস্থান, মাছ ধরার কলাকৌশল এবং জেলেদের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় এ এলাকা থেকে ৯০৫টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে, যার মধ্যে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) বিপজ্জনক প্রজাতির লাল তালিকায় স্থান পাওয়া অনেক প্রজাতিও রয়েছে। স্থানীয় মৎস্যজীবী ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে গবেষণায় প্রাপ্ত নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে নাফ নদীর মোহনা, সেন্ট মার্টিন ও তৎসংলগ্ন ২ হাজার ৮৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার সুপারিশসহ একটি কারিগরি রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে? এতে প্রস্তাবিত এমপিএকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে চার স্তরের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

যার প্রথম অঞ্চলটি হবে একটি রেড জোন, যেখানে মাছ ধরতে অনুমতি দেওয়া হবে না। দ্বিতীয় অঞ্চলেও কোনো মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া হবে না, তবে শর্তসাপেক্ষে জলযান নোঙর করা যাবে। তৃতীয় অঞ্চলটি, সাধারণত একটি বাফার জোন হবে, যেখানে জলযান নোঙর করা এবং মাছ ধরা যাবে। চতুর্থ অঞ্চল হবে সবুজ অঞ্চলের মতো হবে, যেখানে গবেষণা কার্যক্রমের পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে পর্যটন কার্যক্রম চলতে পারে।

প্রস্তাবিত এমপিএ প্রবালের আবাসস্থল এবং এর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে রঙিন রিফ মাছের পাশাপাশি মেগাফনা, যেমন হাঙর, স্কেট, রশ্মি, কচ্ছপ ও ডলফিনকে টেকসইভাবে সংরক্ষণ করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়োপযোগী উদ্যোগ। টেকসই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং জেলে সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে।

নাফ নদীর মোহনা, সেন্ট মার্টিন ও তৎসংলগ্ন ২ হাজার ৮৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করলে তা এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের ১০ শতাংশ ঘোষণার যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তার ২ দশমিক ৪ শতাংশ অর্জিত হবে। গবেষণা প্রতিবেদনটিতে নাফ-সেন্ট মার্টিনকে কার্যকর সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে । যেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত পদক্ষেপে স্থানীয় নেতারা এবং জেলেদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। প্রস্তাবিত সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকাকে সামুদ্রিক মৎস্য আইন-২০২০-এর ধারা ৩ অনুসারে ঘোষণা করা। বিপদাপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য ও মেগাফনার আবাসস্থল সংরক্ষণ এবং অন্যান্য জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য একটি সামগ্রিক পদ্ধতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জোর দেওয়া; প্রবালপ্রাচীর রক্ষা করা এবং সামুদ্রিক শৈবাল সংগ্রহ সীমিত রাখতে হবে, পানিদূষণ রোধ করতে হবে, প্লাস্টিক এবং পরিত্যক্ত জাল প্রবালপ্রাচীরের নীরব ক্ষতিকারক। তাই এসব সামগ্রী নিয়মিতভাবে অপসারণ করতে হবে এবং প্রস্তাবিত নাফ-সেন্ট মার্টিন সংরক্ষিত এলাকার ওপর নির্ভরশীল জেলে ও গরিব জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করা এবং তাদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা।

[email protected]