শিল্পাচার্য জয়নুল ও বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্প

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও শিল্পাচার্য জযনুল আবেদিন

এ দেশের মাটি ও মানুষের শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মবার্ষিকী ২৯ ডিসেম্বর। জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের এই দিনে কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দুয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ সংগ্রহশালার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। জন্মদিনে শিল্পাচার্যের প্রতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা।

কোনো দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সে দেশের লোক ও কারুশিল্প। প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে শিল্পাচার্য লোক ও কারুশিল্পের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন এবং এ বিষয়ে গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। স্বাধীনতার আগে তিনি ঢাকা জাদুঘরে একটা ফোক আর্ট গ্যালারি স্থাপনের কথা তিনি চিন্তা করছিলেন। পাকিস্তান আমলে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। অবশেষে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর বহু দিনের সে স্বপ্ন সফল হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর তদানীন্তন সচিব ড. সাত্তার এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এভাবে ১৯৭৪ সালের ১২ মার্চ গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ ফাউন্ডেশন গঠিত হয়। লোক ও কারুশিল্প সংগ্রহ এবং কারুপল্লি স্থাপন এ ফাউন্ডেশনের মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে এ–সংক্রান্ত রেজুলেশনে উল্লেখ করা হয়। ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে ইতিহাসবিজড়িত নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে এ ফাউন্ডেশন স্থাপিত হয়, যা জনসাধারণের কাছে ‘সোনারগাঁ জাদুঘর’ নামে পরিচিত।

১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে সরদারবাড়ি নামক পুরোনো জমিদারবাড়ি মেরামত করে তাতে লোকশিল্প জাদুঘর স্থাপিত হয়।

বর্তমানে তিনতলা জাদুঘর ভবনে এক হাজারের বেশি লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। আরও তিন হাজারেরও বেশি কারুশিল্প নিদর্শন ফাউন্ডেশনের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব সংরক্ষিত সামগ্রী প্রদর্শনীর জন্য জাদুঘর ভবন সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন ভৌত সুবিধাদি বৃদ্ধির একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় সাত লাখ দর্শনার্থী এ জাদুঘর ও ফাউন্ডেশন চত্বর পরিদর্শন করে। ফাউন্ডেশন ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মধ্যবর্তী জমি অধিগ্রহণ করে একটি কারুশিল্প গ্রাম প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে দর্শনার্থীরা কারুশিল্পের বিভিন্ন উপাদান, যেমন: জামদানি শাড়ি, নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, কাঠ-বাঁশ-বেতের পণ্য তৈরি প্রক্রিয়া, তথা কারুশিল্পীদের দক্ষ হাতের কাজের প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পাবেন। ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসের অন্যতম আকর্ষণ বড় সরদারবাড়িটিকে দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংগওয়ান করপোরেশনের আর্থিক সহযোগিতায় এবং বিশিষ্ট স্থপতি আবু সাঈদের পরিকল্পনায় পাঁচ বছর ধরে রেস্টোরেশন কাজ সম্পন্ন করে তা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত কবে দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ ও মোগল স্থাপত্যের এক অদ্বিতীয় নিদর্শনটিকেও কারুশিল্পের বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে সজ্জিত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। সোনারগাঁ জাদুঘরের পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক পানাম নগরী।

জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯–এর মতো অতিমারি মোকাবিলায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের তৈরি দ্রব্য বর্জন করে দেশজ উপাদান, যেমন: মাটি, পাট, বাঁশ, বেত, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যসম্মত এবং সুলভ পণ্য ব্যবহার করলে একদিকে প্রান্তিক মৃৎশিল্পী, দারুশিল্পী, জামদানিশিল্পীসহ সব কারুশিল্পীর জীবন ও জীবিকা রক্ষা পায়, অন্যদিকে এ দেশের জলহাওয়ায় জন্ম নেওয়া প্রাকৃতিক উপাদানের জন্য কৃষক/উৎপাদকের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায়। বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে পাট, বাঁশ বা মাটির তৈরি এসব কারুপণ্যের রপ্তানি ক্রমেই বাড়ছে। কারুপণ্যের নকশা, মোটিফ এবং প্রস্তুতের পদ্ধতিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পদ। ইতিমধ্যে ইউনেসকো জামদানি ও শীতলপাটির বুননপদ্ধতিকে ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। কারুশিল্পীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, মধ্যস্বত্বভোগীমুক্ত বিপণনব্যবস্থা, সহজ শর্তে ঋণ নিশ্চিত করা গেলে আমাদের গর্বের এ সম্পদ রক্ষা করার পাশাপাশি সবার জন্য একটি বাসযোগ্য ও টেকসই পৃথিবীর অর্জনেও বাংলাদেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।

*লেখক: ড. আহমেদ উল্লাহ পরিচালক (উপসচিব), বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন