শিক্ষায় রূপান্তর, রূপান্তরের শিক্ষা

ফাইল ছবি

অকটেনচালিত কোনো গাড়ি যখন সিএনজি বা এলপিজিতে চালানোর চিন্তা করা হয়, তখন একটি পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে নতুন জ্বালানিতে গাড়িটি চলে। এ ধরনের বহু রূপান্তরের ঘটনা রয়েছে, যা আমরা চলতে-ফিরতে গ্রহণ করি। জীবনযাপনের প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে এ ধরনের নানা রূপান্তর আমরা মেনে নিই, নিতে হয়। আমাদের শরীর অসুস্থ হলে একটু নরম বা জাউভাত খাই, বার্লি-সুজি খাই। পরিস্থিতি বুঝে কখনো স্যালাইন খেতে হয়, শিরায় স্যালাইন দিতে হয়, প্রয়োজন হলে কখনো নাকে নল ঢুকিয়ে বিকল্প উপায়ে জিইয়ে রাখতে হয় রোগীর সঞ্জীবনী শক্তি।

শিক্ষার রূপান্তর নিয়ে চিন্তা করলে দেখব যে এই করোনাকালে দ্রুত আমাদের অফলাইন থেকে অনলাইনে যেতে হলো। কিন্তু এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষার রূপান্তরের জন্য আমরা কতটা সময় দিয়েছি? অনলাইন থেকে যদি অফলাইনের মতো সবকিছু প্রত্যাশা করি, তবে তা ভুল চাওয়া হবে। অনেক সময় শিক্ষক হিসেবে হয়তো আমরা বুঝি না, শিক্ষার্থীদের সিলেবাস কেমন হবে, আগে কীভাবে আমরা পাঠদান করতাম এবং এখন কীভাবে তা করা প্রয়োজন। এমন বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে বড় পরিবর্তন মানিয়ে নেওয়া আদতে কঠিন।
বর্তমানে একটি ট্রেন্ড চালু হয়েছে, মানুষ একটি সম্পূর্ণ নাটক বা চলচ্চিত্র না দেখে বরং ওই নাটক বা চলচ্চিত্রের দু-তিন মিনিটের ক্লিপ বেশি পছন্দ করছে। বলছিনা যে আমাদেরও এভাবে শিক্ষার কনটেন্ট তৈরি করতে হবে। তবে এই রূপান্তরের প্রশ্নগুলো নিয়ে আমাদের, বিশেষত শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাবতে হবে। শিক্ষার প্রথম ও প্রধান কাজই হলো শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো, শিক্ষার্থীকে শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা। রূপান্তরের কালে এ কথা মনে রাখা জরুরি।

কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলমান এই পরিবর্তন বা রূপান্তরের কথা ভাবলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কলেজ–স্কুলপর্যায়ে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করেই সংকট অতিক্রম করতে চাইছি আমরা। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে, শুধু সিলেবাস ছোট করে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে চাইলে সম্ভব কি না, সেটাও ভাবতে হবে। সিলেবাস সংক্ষিপ্ত হলেও তা যেন আধুনিক ও শক্তিশালী হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। করোনাকালে রূপান্তরের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণ একটি পদ্ধতি হলেও মানের দিকটি সতর্কভাবে খেয়াল রাখতে হবে।

করোনার কারনে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি চলছে
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বড় বড় টেলিভিশন সেটে আমরা আগে অনুষ্ঠান উপভোগ করতাম। বর্তমানে পাতলা টেলিভিশন বসার ঘরে শোভা পায়। টেলিভিশনের ওজন ও আকার ছোট হলেও কোয়ালিটি বা গুণগত মান ও ঝকঝকে ছবি দেখার নিশ্চয়তা কিন্তু বেড়েছে। হাতের মুঠোফোনটির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফোনটি আগের তুলনায় হালকা–পাতলা হলেও তাতে যোগাযোগ, ব্যাংকিং ও কম্পিউটারের অনেক প্রয়োজনীয় ফিচার যুক্ত হয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। নিজের বাসাবাড়ি ছেড়ে থাকতে পারলেও ফোন-ইন্টারনেট সেবা ছেড়ে থাকা কঠিন। শিক্ষাক্ষেত্রেও এমন কিছু দিক আমাদের দেখতে হবে, যা হয়তো পরিসর বিবেচনায় ছোট হবে, কিন্তু গুণগত মান বিবেচনায় তা হবে সর্বাধুনিক ও যুগশ্রেষ্ঠ এবং শিক্ষার্থীদের কাছে তুমুল আগ্রহের বিষয়।
শিক্ষার এই অনিবার্য আধুনিকীকরণ নিয়ে যদি আমরা চিন্তা করতে ব্যর্থ হই, তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।

আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো রয়েছি, যারা রূপান্তরকে দ্রুত গ্রহণ করতে চাই না বা বেগ পেতে হয়, তাদেরও মনে রাখতে হবে, এই রূপান্তর স্বাভাবিক ও অনিবার্য। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো যুগের সঙ্গে সন্ধি ঘটানো, পরিবর্তনকে মানিয়ে নিয়ে সামনে চলা। আমরা এখন অপেক্ষায় রয়েছি কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। এখানে একটি বড় প্রশ্ন, এখনই যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যায়, তবে কি আমরা আগের মতো অবস্থায় ফিরে যাব? আর শিগগিরই যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলে, তবে আমরা এখন যেভাবে চলছি, সেভাবেই চলতে থাকব? বিষয়টি ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।

লেখক: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক।