মেসিকে দেখার আনন্দ

মেসি।
ছবি: রয়টার্স

২০১৪ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল বিশ্বকাপ স্পর্শ করার। অথচ ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে মেসিকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল শিরোপার খুব কাছে এসেও।

গ্রুপ ম্যাচে মেসির পারফরম্যান্স প্রত্যাশার পারদ আকাশচুম্বী করেছিল তাবৎ মেসিভক্তদের মনে। কেবল তা–ই নয়, খোদ ব্রাজিলের ফুটবলপ্রেমীরাও ভেবে নিয়েছিল বিশ্বকাপ জেতা মেসির জন্য সময়ের ব্যাপার। সুন্দর ফুটবলের পূজারি হিসেবে ফাইনাল ম্যাচে পুরো ব্রাজিল হয়ে পড়েছিল মেসিভক্ত।

এর আগে গ্রুপ পর্বে ইরানের বিপক্ষে যখন মেসির দেওয়া একমাত্র গোলে আর্জেন্টিনা জিতল, ব্রাজিলের রবিবাসরীয় দৈনিকে শিরোনাম করেছিল:
‘না সেলেকাও দো পাপা কুয়েম ফাজ মিলাগ্রে ই মেসি’।

সহজ অনুবাদে,
‘মেসির মতো এই অলৌকিক ঘটনা একমাত্র পোপই করতে পারতেন!’
অন্য একটি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় সবিস্তারে প্রকাশিত হয়েছিল, ‘কেন মেসিকে আপনার না দেখলেই নয়!’ শিরোনামে। সাথে উল্লেখ করেছিল কোন ১০ কারণে মেসি অনন্য।

সেই ১০টি কারণ ছিল,
১. বিশ্বের যেকোনো খেলাতেই এক নম্বরকে দেখার সুযোগ ছাড়তে নেই।
২. এমন সুযোগ বারবার আসবে না। কবে আবার এ দেশে পাওয়া যাবে, আদৌ যাবে কি না, কেউ জানে না।
৩. ম্যাচের রাজা বস্তুটা কী, সেটা চোখে দেখা দরকার।
৪. ইরানের সঙ্গে গোলটা যেমন মনে একটা বিনা পয়সার অ্যালবাম তুলে ফেলা, তেমন আরও স্মৃতি তৈরির সুযোগ।
৫. আক্রমণ শাণানো বলতে কী, সেটা প্রত্যক্ষ করা।
৬. ফুটবল মাঠের তীক্ষ্ণ অ্যান্টিসিপেশন শিক্ষা।
৭. ব্রাজিলের তথাকথিত শত্রু দেশের ফুটবলার কেমন সম্মানিত হতে পারে, তা হাতেকলমে দেখা।
৮. রেকর্ডের চাপ নেওয়ার শিক্ষা।
৯. দেখা, পৃথিবীব্যাপী অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়তে হয়!
১০. একটা এক্স–ফ্যাক্টর প্রত্যক্ষ করা, যার কোনো ব্যাখ্যা হয় না।

মেসি
ছবি : রয়টার্স

বছর ঘুরে এখন ব্রাজিলের মাঠে কোপা আমেরিকা সূত্রে মেসি আবার ফিরে এসেছেন। আবার আশায় বুক বেঁধেছেন মেসিভক্তরা।

১৯৮৭ সালের ২৪ জুন সকাল ছয়টায় আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্মেছিলেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। ছোটবেলায় মেসির হিরো ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। মেসির রুমের দেয়ালে ম্যারাডোনার পোস্টার লাগানো থাকত। পাঁচ বছর বয়সে প্রথম স্বপ্নে দেখেছিলেন তাঁর হিরোকে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই নানি সিলিয়াকে মেসি জানালেন, স্বপ্নে ম্যারাডোনাকে গোলরক্ষক হিসেবে খেলতে দেখেছেন। বুঝে উঠতে পারছিলেন না ম্যারাডোনার বিপক্ষে গোল দেওয়া ঠিক হবে কি না। কিন্তু ম্যারাডোনা চিৎকার করে তাঁকে বলেছিলেন, ‘লিও, আমাকে গোল দাও তো দেখি!’ ড্রিবল করে স্বপ্নের নায়ককে কাটিয়ে বাঁ পায়ের জোরালো শটে যখন গোল দিলেন, তখন নাকি ম্যারাডোনা মুচকি হেসে মেসির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়েছিলেন।

নানি সিলিয়া ছোট্ট মেসির কথা বিশ্বাস করেছিলেন। তিনিও স্বপ্ন দেখতেন মেসি একদিন বড় ফুটবলার হবেন। তাই চতুর্থ জন্মদিনে কিনে দিয়েছিলেন নাতিকে প্রথম নীল-সাদা রংয়ের ফুটবল। এরপর প্রতিবছর জন্মদিনে সিলিয়া উপহার দিতেন একটা করে নতুন ফুটবল। সারা দিনের সঙ্গী ছিল সেই ফুটবল। বন্ধুরা তাঁকে ডাকতেন ‘ফ্লি’ বা ‘ছোট মাছি’ নামে। সারা দিন বল পায়ে ছুটে বেড়ানো। এমনকি রাতেও সেই ময়লা বল নিয়ে ঘুমাতেন মেসি। কেউ যেন না দেখে ফেলে সেই জন্য চাদর দিয়ে বলটাকে মুড়িয়ে জড়িয়ে রাখতেন।

বড়বেলায় মেসি ফুটবল খেলেছেন অবাধ স্বাধীন আনন্দে। কিংবদন্তি শিল্পী বব মার্লে যেমনটি বলেছিলেন, ‘ফুটবল নিজেই একটা শিল্প। পুরো জগত সেটা। পুরো মহাবিশ্ব এর ভেতর। ফুটবল মানে মুক্তি।’

ফুটবল বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আগামীকাল যদি বার্সালোনাতে মেসির ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়, তবে তাঁর কোনো ক্ষতি নেই। মেসির অর্জন ক্লাব পর্যায়ে যেকোনো ফুটবলারের জন্য স্বপ্ন। মেসির পক্ষে আর কী করা সম্ভব, তা জানার জন্য তাঁর শেষ অবসরের ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

মেসির সামনে এখন দুটি চ্যালেঞ্জ। ১৯৯৩ সালের পর কোপা আমেরিকা কাপ আর্জেন্টিনায় ফিরিয়ে আনা এবং অবশ্যই ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ জেতা। সম্ভবত জাতীয় পর্যায়ে মেসির বিশ্বকাপ জেতার এটাই শেষ সুযোগ। মেসি গত দুই বিশ্বকাপ আর কোপা আমেরিকায় নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিয়েও টিম কম্বিনেশনের অভাবে সর্বোচ্চ সাফল্য না পাওয়ায় নিজ দেশে অতি আবেগী আর্জেন্টাইনদের কাছে হয়েছিলেন ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল তাঁর পিতার আর্থিক ট্যাক্স–সংক্রান্ত মামলায় জড়িয়ে পড়া।

আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলে ’৭৮ বিশ্বকাপজয়ী কোচ সিজার লুই মেনেত্তি উপদেষ্টা ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মেসি অ্যান্ড কোং আবার নতুন আশায় বুক বেঁধেছিল। বর্তমানে লিও স্কলানির দল অনেক গোছানো। গত কয়েক মাসে আর্জেন্টিনার খেলার ধরনে অনেক উন্নতি হয়েছে, যেটা মেসির নিজের জন্যও স্বস্তিদায়ক।

আমাদের প্রজন্ম পিরামিড বানানো দেখিনি, রোমান কলোসিয়াম গড়তে দেখিনি, কোনারক-তাজমহল-আইফেল টাওয়ার কিছুই নিজ চোখে তৈরি হতে দেখিনি। এমনকি মাইকেল এঞ্জেলোর অনুপম ভাস্কর্য ডেভিড সৃষ্টির সময়েও আমরা জন্মাইনি।
কিন্তু ‘খুদে জাদুকর’ কিংবা ‘ভিন গ্রহের খেলোয়াড়’ লিওনেল মেসিকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।

শুভ জন্মদিন লিও!
*লেখক: চিকিৎসক, শিল্পী