মেসবাহউদ্দিন আহমেদ স্যার: মানুষ গড়ার কারিগর

প্রতিযোগিতার এ বিশ্বে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই শুধু এই স্বপ্ন দেখে, অনেক ভালো ফলাফলের সঙ্গে শিক্ষাজীবন শেষ করে একটি সফল পেশাগত জীবন অতিবাহিত করবে। মূলত সামাজিক ও পারিবারিক চাপেই শিক্ষার্থীরা যেখানে কেবল শিক্ষাগত শ্রেষ্ঠত্ব ও পেশাগত সাফল্যের পেছনে অন্ধ হয়ে ছুটে চলছে, সেখানে তাদের সবার আগে একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য সর্বদা উপদেশ দিয়ে গেছেন ও অনুপ্রাণিত করে গেছেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মোল্যা মেসবাহউদ্দিন আহমেদ স্যার।

শিক্ষার্থী এবং তাদের সার্বিক মঙ্গল ঘিরেই যেন তাঁর জীবন। শিক্ষার্থীদের জন্য তাঁর কক্ষের দরজা সব সময় খোলা থাকত। তারা তাদের যেকোনো আবদার, নালিশ, দুঃখ-কষ্টের কথা, এমনকি শিক্ষা কিংবা সহশিক্ষা কার্যক্রম-সংক্রান্ত বিভিন্ন পরামর্শ নিয়েও সরাসরি অধ্যক্ষ স্যারের কাছে যেতে পারত। তিনি তাদের সব কথা গুরুত্বের সঙ্গে শুনতেন এবং যৌক্তিক হলে তাদের দাবি, পরামর্শ, অনুরোধ দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করতেন।

শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও এই অবাধে যোগাযোগ রক্ষা করার মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি এবং শিক্ষার্থীদের যাবতীয় চাহিদা সম্পর্কে সর্বদা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবগত হয়ে তাদের স্বার্থে সর্বোত্তম ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং উদ্যোগ গ্রহণ করতেন। এর ফলে একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য যোগাত্মক পরিবর্তন এসেছে, তেমনি শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবি-অনুরোধ নিয়ে সরাসরি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের কাছে নিঃসংকোচে যেতে পেরে প্রতিষ্ঠানকে আপন মনে করতে পেরেছে।

ঠিক একইভাবে অভিভাবকদের সঙ্গেও বিভিন্ন সময়ে নিয়মিত অভিভাবক সভার মাধ্যমে তাঁদের কাছ থেকে শুনতেন যে তাঁরা তাঁদের সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আর কী কী উদ্যোগ কিংবা পরিবর্তন প্রত্যাশা করছেন। যদিও এসব অভিভাবক সভায় উপস্থিত অভিভাবকেরা প্রত্যাশার চেয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় মেসবাহ স্যারের দক্ষতা ও বিচক্ষণতার প্রতি সন্তুষ্টি এবং পূর্ণ আস্থাই বেশি ব্যক্ত করতেন। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে অভিভাবকদের যুক্তিসম্মত প্রত্যাশাগুলো তিনি কার্যে পরিণত করতেন অবিলম্বে।

মেসবাহ স্যার বুঝতেন যে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং তখন তাদের পুনরায় সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন অনুপ্রেরণা ও সঠিক দিকনির্দেশনা। তাই তারা যেন লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়ে যায়, এ জন্য তিনি নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মোটিভেশনাল (অনুপ্রেরণামূলক) ক্লাস নিতেন। তাদের উৎসাহ দিতেন, তাদের কষ্টের কথা শুনতেন এবং সে কষ্ট থেকে বের হওয়ার উপায় বলতেন। তা ছাড়া যেমনটা আগে উল্লেখ করেছি, প্রতি ক্লাসেই তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছে প্রধান চাওয়া থাকে, তারা সবার আগে একজন ভালো মানুষ হবে, সেই সঙ্গে মা-বাবা-শিক্ষকের আদেশ-উপদেশ মেনে চলবে এবং মন দিয়ে লেখাপড়া করবে।

করোনাকালে শিক্ষার্থীরা যেন উদাসীন না হয়ে পড়ে এবং সুষ্ঠুভাবে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারে, সে জন্য গত বছরের মার্চ মাস থেকেই তিনি নিয়মিত অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করা শুরু করেন। পাশাপাশি তাদের মানসিক সুস্থতার স্বার্থে তাদের জন্য অনলাইনেও মনোবিজ্ঞানীর মাধ্যমে মোটিভেশনাল ক্লাসের ব্যবস্থা করেন এবং নিজেও নিয়মিত সব শ্রেণির শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলতেন। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে ছাত্রীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলার জন্যও তিনি মনোবিজ্ঞানী দ্বারা বা এ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকের মাধ্যমে বিশেষ ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত নূর মোহাম্মদ কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত এই মহান ব্যক্তির গুণের বর্ণনা এবং কলেজের প্রতি তাঁর অবদানের বিবরণ শেষ হওয়ার নয়। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর অসংখ্য উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তাঁর যাবতীয় দায়িত্ব তিনি সর্বদা নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করে গেছেন। কর্নেল মেসবাহ স্যার দায়িত্ববোধ, সুশিক্ষা ও মমতার সূর্যালোকে আলোকিত একজন আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর, একজন আদর্শ অধ্যক্ষ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোর পথে পরিচালিত করার নেপথ্যে এমন শিক্ষাগুরুর অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি অত্যাবশ্যক।

*লেখক: নাফিস এহসাস চৌধুরী, সাবেক প্রিফেক্ট, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ