মুগ্ধতা জড়ানো এক কাপ চা

‘আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।’
আমাদের সবারই চিরচেনা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই অমলকান্তি। তার মতো রোদ্দুর হতে চাওয়া এমন বন্ধুকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারা আমার জন্য ভারি আত্মতৃপ্তির। এই তো কদিন আগে আমি আমার ওয়ালে লিখেছিলাম, চায়ের মতো আভিজাতিক এবং সিভিলাইজড আর কোনো পানীয় হতে পারে না। আপনি যখন কোনো বন্ধুকে বলবেন, দোস্ত, বিকেলে টিএসসি অথবা হাকিম চত্বরে আসিস, দেখা হবে। এই জায়গাগুলোর নাম মুখে নিতেই চোখে ভাসে এক কাপ চা। হোক তা আদা-লেবু দেওয়া রং-চা কিংবা টিনের কৌটার এক কোনা কাটা ফালি দিয়ে ঝড়ের গতিতে বানানো দুধ-চা।

আমার এমন কিছু বন্ধু আছে, যারা এখনো টিএসসি গেলে একসঙ্গে দুই কাপ লেবু-চা দুহাতে নিয়ে খায়। এক কাপ নিজের জন্য আরেক কাপ অতীত হয়ে যাওয়া প্রিয় সেই মানুষটার সৌজন্যে। কী মমতায় জড়ানো সেই চুমুক!
ছবির হাঁটে যায়নি বা সেখানকার চা-পিয়াজু খায়নি—এমন প্রেমিক-প্রেমিকা মেলা ভার এ শহরে। অথবা পলাশির মোড়। পলাশি নিশ্চয়ই সবার খুব চেনা এক নাম। যেখানে সারা রাত খোলা থাকে চা-শরবত এবং স্ট্রিট খাবারের দোকান। শুধু বুয়েটের ছাত্রছাত্রীরাই নয়, এমন কোনো মানুষ নেই বিশ্ববিদ্যালয়পাড়ার, যারা ওই কাঁচাবাজারের চা, বেগুনি. নুডলস হাতে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে কাটায়নি। জীবন যেন সেই মুহূর্তে এক কাপ চায়েই অমৃত, আহা!

পরীবাগে নাকি আউলাঝাউলা লোকের আনাগোনা বেশি। তাতে কী! এমন বাউন্ডুলে টাইপ মানুষই কিন্তু যেকোনো আনন্দদায়ক সৃষ্টির জন্য সেরা। পরীবাগের টং দোকানের চা খেয়ে অনেকেই আজ শিল্প-সাহিত্যের জগতে নিজেকে আলোকিত মানুষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। আসলে পথের মোড়ের চায়েই বুঝি তৃপ্তি আর সুখ সবচেয়ে বেশি।
বেইলি রোড এক আধুনিক আভিজাতিক পাড়া, তাতে কী—এ শহরে যেখানে রিকশা চলে, সেটাই আমার কাছে নিজের মহল্লা। তাই কমবেশি অনেকের সঙ্গেই সেখানে আড্ডা-দেখা-গল্প হয়েছে অতীতে, এমনকি এখনো হয়। হাতে থাকে সেই বিখ্যাত সরু কাচের চায়ের কাপ। আর রাস্তার পাশেই বানানো গরম-গরম পিয়াজু। শিল্পকলার কথা না বললে তো শিল্প-সাহিত্যের জগতের বন্ধুরা আমাকে আস্ত রাখবে না। সেখানকার কফি হাউস শিল্পীদের ব্যাপক আড্ডার জায়গা। আর শিল্পকলার দুপাশের গেটের সামনে সন্ধ্যার পর থেকে মুখরিত শৈল্পিক আড্ডা জমে যেন চায়ের কাপে ঝড় তোলে।
আজকাল শহরে অনেক বই পড়ার জায়গা হয়েছে। সেসব জায়গাতে বই পড়ার পাশাপাশি পাঠকদের জন্য রাখা হয়েছে চায়ের ব্যবস্থা। বৃষ্টির দিনে অমন মনোরম পরিবেশে বই আর পাশে ধোঁয়া ওঠা গরম চা। আহ, জীবন অল্পতেই কী রকম জলমাখা এক ছবি!

ঘুম–জড়ানো চোখে প্রিয় কোনো মানুষকে যখন দেখবেন চায়ের মগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আপনার শিয়রে, আমি দিব্যি করে বলতে পারি, শত অভিমান ভুলে আপনি ডুবে যাবেন ভালো লাগার এক অনিন্দ্য সৌরভে। কিংবা আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষটি যখন আপনার থেকে অনেকটা দূরে। ভীষণ মিস করছে আপনাকে, সঙ্গে আপনার হাতে বানানো এক কাপ চা। অনুনয় নিয়ে বলছে, প্রিয়তা, আমার চায়ের রংটা একদম তোমার মতো হয়নি, কী দাও তুমি? অমন ঘন দেখায়। বোকা বালক, ওভাবে নয়, এভাবে বানাতে হয় চা। প্রযুক্তির মাধ্যমে ভালোবাসা মেশানো এক আবিষ্কার শিখিয়ে দিল প্রিয়তা তার কাছের মানুষটিকে। আসলে কখনো কখনো চা হয়ে ওঠে অভিমান ও ভালোবাসা জড়ানো এক সুখানুভূতি। কত প্রেমিক অজান্তে বদলে নিয়েছে প্রেমিকার সঙ্গে নিজের চায়ের পেয়ালা, তা যেন বুঝেও না বোঝার ভান করেছে সেই প্রেয়সীরা।

পাড়া–মহল্লা, হাট–বাজার, শহর–নগর, কোথায় নেই মুখরিত চায়ের আড্ডা? রাজনীতি, ক্রিকেট, দেশ, হত্যা, গুম, খুন, ধর্ষণ— দেশ–বিদেশের যাবতীয় আলোচনায় ওঠে চায়ের কাপে ঝড়। চা ছাড়া কি বাঙালির এক দিনও চলে, বলুন? ব্রিটিশরা আর কিছু না হোক, এই একটা ভালো অভ্যাস আমাদের দারুণভাবে শিখিয়ে গেছে।
এ শহরের খুব কম জায়গা আছে, যেখানে আমি চা খাইনি। আজকাল খিলগাঁও তালতলাও বেশ জমে উঠেছে চা–কফির মাতোয়ারা গন্ধে। পল্টনের সেই বটতলা, যেখানে এই কঠোর লকডাউনেও চলে গিয়েছি দুই বন্ধু চা খেতে। এখনো যদি কারও বাসায় বেড়াতে যাই, ড্রয়িংরুমে বসে শুনতে পাই কাপ–পিরিচের টুংটাং আওয়াজ, উফ্‌ কী এক মোহনীয় ভালো লাগা কাজ করে ভেতরে-ভেতরে, তা কী করে বোঝাই!
আমি খুব স্বল্পাহারী একজন মানুষ, কিন্তু আমার বাসায় এসে এক কাপ চা খাবে না—এমন দুর্ঘটনা আজও কারও সঙ্গে বোধ হয় বিশেষ কারণ ছাড়া ঘটেনি। এ শহরের সব রিকশাওয়ালা আর টং দোকানের চা–মামারা আমার সবচেয়ে পছন্দের। তবে যে চা সবচেয়ে জঘন্য, সেটা হলো জাতীয় প্রেসক্লাবের দুই টাকা দামের চা। কথায় বলে না সস্তার বারো অবস্থা, ঠিক সে রকম। তবু আমি প্রেসক্লাবে যাই এক কাপ চায়ের লোভে।

সম্প্রতি একটা গ্রুপ থিয়েটার থেকে শ্রীমঙ্গল গিয়েছিলাম। সেখানে পরিচিত এক দাদা আমাদের তাঁর নিজস্ব চা–বাগানে নিয়ে গিয়েছিলেন। শ্রীমঙ্গলে গিয়ে আমার একবারের জন্যও ঢাকা ফিরতে ইচ্ছা করেনি। আল্লাহর কী অপূর্ব সৃষ্টি! কী মমতা আর মায়ায় জড়ানো কচি সবুজ পাতার সাজানো সমারোহ। সেখানে চা–বাগানে কাজ করছেন অসংখ্য নারী ও শিশু শ্রমিক। সময়ের স্বল্পতার কারণে কথা বলা হয়নি সেসব খেটে খাওয়া পরিশ্রমী মানুষের সঙ্গে। তাই অপেক্ষায় আছি আবার ওই সবুজে ঘেরা চায়ের দেশে যাওয়ার। তখন একটা গল্প নিশ্চয়ই লিখব ওই চা–বাগানে কাজ করা মানুষগুলোকে নিয়ে।

যেকোনো নেশাই ক্ষতিকর। হোক তা পান–সিগারেট কিংবা চা-কফি। সবকিছুরই একটা স্বাভাবিক ছন্দ থাকা উচিত। আর যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তা এড়িয়ে চলা মানবিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। চা–কফি পান খুব বেশি ক্ষতিকর না হলেও সিগারেট কিন্তু মরণব্যাধি ক্যানসারের কারণ। তাই আসুন সিগারেট ছেড়ে দিই। নিজের স্নিগ্ধতা হারাতে না দিই রাতের পর রাত জেগে সেল ফোন ঘেঁটে আর মগের পর মগ চা-কফি খেয়ে। নেশা বড় কঠিন জিনিস?ভলোলাগার মতো এক মুগ্ধতা যেন। মনে আছে নিশ্চয়ই ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’র কথা? বিধবা পিসিমাকে লুকিয়ে দরজা–জানালা বন্ধ করে রোজ চা খাওয়াত বিনোদিনী।

দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর হতে যাচ্ছে আমরা সারা পৃথিবীর মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছি এক অসহনীয় জীবনধারা। জানি না কবে মুক্তি? কত নিম্ন আয়ের মানুষ কর্মহীন হয়ে কাটাচ্ছে কঠিন দিন।

খুব দুঃখ হয় পথের ধারে টং দোকানের চা–ওয়ালা, পানওয়ালা, ফুচকা-বাদামওয়ালাদের জন্য। স্বল্প পুঁজিতে ক্ষুদ্র এসব ব্যবসায়ী কীভাবে দিনাতিপাত করছেন, তা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের যেমন, তেমনি সামাজিক জীব হিসেবে আমার-আপনারও। আমরা প্রার্থনা করি আমাদের ফেলে আসা সেসব দিনের। আবার জমে উঠুক ছাত্রছাত্রীদের প্রাণের ক্যাম্পাস। মুখরিত হোক শহরের সব অলিগলি। পাখিরা আকাশে উড়ে বেড়াক ডানা মেলে। শিশুরা রাজা–রানি হোক নিজেদের ভূরাজ্যে। আমরা গান গাই প্রাণভরে। থেকে যাক বৃষ্টিভেজা আমার শহরের ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চায়ের মিষ্টি সুগন্ধ।
*রোজিনা রাখী, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ